‘গার্ডিয়ান’র নাম শোনেনি এমন সংবাদকর্মী ও সংবাদ পাঠক খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ১৮২১ সালে যাত্রা শুরু করা এ দৈনিক পত্রিকাটি সাংবাদিকতার জগতে যথেষ্ট সম্মানীয় স্থান দখল করে রয়েছে। ২শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী গার্ডিয়ান কেবল যুক্তরাজ্যই নয় গোটা বিশ্বের প্রেক্ষাপটেই একটি প্রথমসারির পত্রিকা।
নিয়মিত গার্ডিয়ান পাঠকরা তো জানেনই, যারা একটু অনিয়মিত তারা এর ওয়েব বা প্রিন্ট ভার্সনে চোখ রাখলেই দেখবেন, ‘সাপোর্ট দ্য গার্ডিয়ান – এভেইলেবল ফর এভরিওয়ান, ফান্ডেড বাই রিডার্স’ আহ্বানটি। কেন এই আহ্বান তা বোঝা যাবে গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করা ‘নিউজ ইজ আন্ডার থ্রেট’ শিরোনামের লেখাটি পড়লে।
হুমকির মুখে সংবাদ
‘…যখন আমাদের এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সৎ, সত্যে অবিচল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পড়তে বিশ্বের লাখো পাঠক গার্ডিয়ানে ভিড় করে। আমাদের জীবদ্দশায় সবচেয়ে বড় যে সমস্যার মুখোমুখি আমরা হয়ে চলেছি, পাঠকদের তা বুঝতে সাহায্য করে গার্ডিয়ান। এই সঙ্কটময় সময়ে, সংবাদমাধ্যমগুলোকে অতীতের তুলনায় দ্বিগুণ আর্থিক নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গুটি কয়েক সংবাদমাধ্যম এই পরিস্থিতিতে কোনোরকমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গোটা ইউকেজুড়েই পড়ে গেছে সংবাদপত্র বিক্রি। বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় মন্দার প্রভাবে বিজ্ঞাপন থেকে আসা আয়ও ক্রমাগত কমছে। এই শূন্যস্থান পূরণে আপনাদের (পাঠক) সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন।
আমরা বিশ্বাস করি, অত্যাবশ্যকয়ীয় জনসেবাকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সমান প্রবেশাধিকার আমাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য। সুতরাং অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা হয়ে আমরা একটি ভিন্ন পথ নিয়েছি। গার্ডিয়ানের সাংবাদিকতা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবার কাছে নিয়মিত আর্থিক অবদান রাখার দাবি রাখছি। যে যার সামর্থ অনুযায়ী আপনারা অবদান রাখবেন, যেভাবে বিশ্বের ১৮০টি দেশে আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে বরাবরের মতো পাশে থেকেছেন।
পাঠকের আর্থিক সমর্থন মানে আমরা সংবাদের প্রয়োজনে তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ ও জট ছাড়ানোর কাজ চালিয়ে যেতে পারবো। এটা আমাদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করে যা এর আগে এতোটা সঙ্কটাপন্ন ছিল না। আমরা ভীষণ কৃতজ্ঞ। আপনাদের সমর্থন আমাদের দরকার, যেনো আমরা মানসম্মত সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে পারি যা উন্মুক্ত ও স্বাধীন এবং সেটা দীর্ঘমেয়াদে। ছোট-বড় যাই হোক, প্রত্যেক পাঠকের অবদান আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।
গার্ডিয়ানের পাশে দাঁড়ান, হোক তা এক ডলার দিয়েই এবং এটি মাত্র এক মিনিট সময় নেয়। ধন্যবাদ।’
এই আহ্বান দিয়েই সারা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্কটময় চালচিত্র বোঝা যায়। গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকার যেখানে এই অবস্থা সেখানে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোর কী দুরাবস্থা সহজেই অনুমেয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাকালীন বৈশ্বিক মহামারী যার প্রভাব সব ক্ষেত্রেই কম-বেশি পড়েছে।
গত ০৩ জুলাই (২০২০) দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ঢাকাসহ ৮ বিভাগে চালু ৮৬ পত্রিকা, বন্ধ ২৫৪টি’। এর ফলোআপ প্রতিবেদন করলে সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না! নিউজপোর্টালগুলোর অবস্থা আরও করুণ। দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ধ্যান-ধারণা এখনও সেকেলে। সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ যে অনলাইন প্লাটফর্ম, সেটি তাদের বোধগম্য হয় না ফলে বিজ্ঞাপনের জন্য এখনও তাদের প্রথম পছন্দ টিভি বা দৈনিক পত্রিকা।
এর বাইরে, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক হলে তো কথাই নেই! সংবাদমাধ্যম যে একটি স্বাধীন সত্ত্বা এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে আপোষহীন– এই বিষয়টি যেনো তাদের কাছে হাস্যকর একটি বিষয়। কাজেই সংবাদ ও সংবাদমাধ্যম আসলেই বহুমুখী হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাপী মন্দার ফলে বিজ্ঞাপন থেকে আয় নেই, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করলে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার সুযোগ নেই। একদিকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করলে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ক্ষুব্ধ, অন্যদিকে জনগণের কথা তুলে ধরলে সরকারের খড়গ। সাংবাদিকরা যাবে কোথায়?
এজন্য গার্ডিয়ানের আহ্বানটি একদম যথাযথ ও যুগোপযুগী। সাংবাদিকের কাজ যেহেতু সত্য তুলে ধরা এবং সে কেবল পাঠক তথা জনগণ ও সত্যের কাছে দায়বব্ধ, কাজেই জনগণের আর্থিক অবদানেই চলবে সংবাদমাধ্যম।