বগুড়া কাণ্ড, নৈতিকতা ও দুর্নীতি

, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-31 04:19:02

এক.
বগুড়ার জেলা প্রশাসন সম্প্রতি এক আলোচিত কাজ করে আলোড়ন তুলেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত নামিয়ে পুলিশ পাঠিয়ে হোটেল রেষ্টুরেন্টে আড্ডারত একদল তরুণ তরুণীদের ধরে বেঁধে এনে নৈতিকতার সবক দিয়েছেন। অনুমান করি প্রথমে ভয়, তারপর ভবিষ্যতে এরকম কাজ না করার সতর্কতা দিয়ে তাদের শাসানি দিয়েছেন জেলা প্রশাসন। পরে অভিভাবকদের হাজির করে তাদের হাতে তুলেও দিয়েছেন। তরুণ তরুণিদের অপরাধ? স্কুল কলেজের ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে তারা আড্ডা মারছিলেন। হয়তো ডেটিং করছিলেন। হয়তো আপত্তিকর ঘন হয়ে পাশাপাশি বসেওছিলেন।

তরুণ বয়সের যে ধর্ম! ঘি-আগুন পাশাপাশি থাকলে সর্বনাশ হতে পারে, এই ভেবে হয়তো জেলা প্রশাসন এইরকম শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমেই জাতির বৃহত্তর ক্ষতি এড়াতে একটু কঠোর হয়েছেন!
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে জেলা প্রশাসন কাজটা কি ঠিক করেছেন?

প্রথমত, এইভাবে তরুণ তরুণীদের একসঙ্গে ধরে এনে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে একত্রিত করে তাদের গোপনীয়তা যে নষ্ট করলেন, সেটা কী নৈতিকতাসম্মত?

দ্বিতীয়ত, ৪০ জন তরুণ-তরুণীর পরিচয় ছবিসূত্রে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের এই হাঁকডাকের ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। এইভাবে তরুণ-তরুণীদের যে সম্মানহানি হলো, সেটা করার আইনি বা নৈতিক অধিকার কি জেলা প্রশাসনের আছে?

তৃতীয়ত, ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ ফাঁকি দেয় কেন? সেই কারণ কি সমাধান করতে পেরেছে জেলা প্রশাসন? শিক্ষক স্বল্পতা, সঠিকভাবে ক্লাস না হওয়া, মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, খেলার মাঠের অপ্রতুলতা, বিনোদনের অভাব- এসব সমস্যার সমাধানে কি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে জেলা প্রশাসন? এইসব তরুণদের কাছে কি একবারও জানতে চেয়েছেন জেলা প্রশাসন, তারা কী চায়? কী তাদের অভিপ্রায়, কী তাদের মনোকষ্ট?

চতুর্থত, পুলিশ-ম্যাজিষ্ট্রেট পাঠিয়ে দল বেধে তরুণদের যখন গ্রেফতার করে একটা আওয়াজ তোলা হচ্ছে তখন জেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের একবারও কি মনে হয়েছে এই তরুণ-তরুণীদের মনের মধ্যে কী ঝড় বইছিলো? এই তরুণ-তরুণীদের জায়গায় নিজেদের সন্তানদের দাঁড় করিয়ে কী ভেবেছিলেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা?

দুই.
বগুড়া জেলা প্রশাসনের মাথা হিসেবে এসব প্রশ্ন খোদ জেলা প্রশাসকের কাছেই করতে চাই। অবশ্য তার আগে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। অনেক বছর আগের কথা। আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সমন্বয়কারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। ঢাকার বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নতুন ভবন তখন হয়নি। ঘাস-গাছ-পাখপাখালি আর অনুপম স্থাপত্য সৌন্দর্যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেই পুরনো ভবনের এমনই চেহারা, পাষাণ হৃদয়ের কেউ সেখানে ঢুকলেও তার হৃদয়ে প্রেমের আকুতি আসতে বাধ্য। বহু বিখ্যাত মানুষের প্রেমের নিরাপদ জায়গা তখন সেটা। তরুণ-তরুণীদের পদভারে গমগম করতো পুরোটা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বিশেষ করে কেন্দ্রের ছাদ এবং ক্যান্টিন তো প্রেমিক যুগলের জন্য আদর্শস্থান। ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের উপস্থিতি কোনো কোনো সময় কেন্দ্রের স্বাভাবিক কাজ কর্মেও ব্যঘাত ঘটাতো। আমরা এসব নিয়ে একটু বিরক্ত ছিলমা। স্যারের সামনে আনা হলো সমস্যাটি।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রথমে এটা ওটা বলে এড়িয়ে যান। পরে আমাদের চাপাচাপিতে নিয়ম করা হলো রাত ন’টার পরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে কেউ থাকতে পারবে না। রাত ন’টার আগে সবাইকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হবে। রাত নটায় কেন্দ্রের ছাদের গেট তালা লাগিয়ে দেয়া হবে। এই প্রশাসনিক সিদ্বান্ত কার্যকর হয় কিনা সেজন্য কয়েকজন একটু কঠিন হৃদয়ের কর্মীকে দায়িত্বও দেয়া হলো।

যা হোক, এরপর রাত নটার পর ভিড় একটু কমেও গেলো। কিন্তু সমস্যা হলো কেন্দ্রের একজন কর্মীকে নিয়ে। তার কাছে এতো অতিথি আসেন যে, রাত ন’টার পরও কেন্দ্রের ছাদে তার অবস্থান করতে হয়। দু’ চার দিনের নিষেধ সত্বেও তাকে দমানো গেলো না। অবশেষে সায়ীদ স্যারের কাছে নালিশ গেলো। স্যার সব শুনলেন। আমাকে নিভৃতে ডেকে বললেন, ওই কর্মীর সাথে আলোচনা করতে। স্যারের প্রস্তাবে আমি একটু বিরক্ত হলাম। প্রকাশও করে ফেললাম সেটা। সায়ীদ স্যার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, দেখো ওর কাছে এতোজন আসে, তোমার কাছে তো আসে না! তার মানে বুঝতে হবে, তার প্রেমের শক্তি আছে। সেটাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। সুতরাং ওই কর্মীর ওপর রুষ্ট না হয়ে ওর মনোভাবের প্রতি সদয় হয়ে ভালভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কর, সেটা সে বুঝবে। সায়ীদ স্যারের পরামর্শটা নিয়ে ভাবলাম। নিজেকে প্রস্তুতও করলাম। পরে আলোচনা করেই সুন্দরভাবে সমস্যাটা সমাধান হলো।

এই গল্প বলার উদ্দেশ্য হলো, সব সমস্যার একটা এথনোগ্রাফিক পর্যালোচনা বা দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। জেলা প্রশাসন যেটাকে সমস্যা বা অপরাধ ভাবছেন, তরুণ-তরুণীরা সেটাকে কীভাবে দেখছেন। তাদের মনোভাবটাও তো জানা দরকার। তাদের ওপর প্রথমেই প্রশাসনের ছুরি না চালিয়ে অবিভাবকের সমানূভূতির হৃদয় দিয়েও তো সমস্যাটাকে সমাধানের পথ বের করা যেতো।

তরুণ বয়সে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। তরুণ-তরুণীরা সমবয়সীদের সাথে আড্ডা মারতে চাইবে, ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে এটাও অস্বাভাবিক নয়। কীভাবে সেটাকে নীতিসম্মত, সমাজসম্মত করা যায় সেটাই চ্যালেঞ্জ। আমাদের তরুণ-তরুণীদের সুস্থ্য বিনোদন বা নীতিসম্মত অবকাশের কোনো ব্যবস্থা কি রাষ্ট্র করতে পেরেছে? সেটা না করেই তাদের ওপর পুলিশিং করাটা কতটা যৌক্তিক সেটাও ভাবা দরকার।

তিন.
বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী হয়তো সমাজের ভালো চেয়েই কাজটা করেছিলেন! তবে এই বগুড়া অনেকবার সন্ত্রাসের কারণে, ভূমি দস্যুতার কারণে, রাজনৈতিক মাস্তানির কারণে জনদুর্ভোগের কারণ হয়েছে। সেসব সংকট এখনো দূরীভূত হয়নি। মাদক, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, পুলিশি হয়রানি, ক্ষমতাবানদের দাপট এখনো বগুড়াবাসী প্রত্যক্ষ করছেন। প্রশাসনের বহু জায়গায় ঘুষ, দুর্নীতি প্রতিদিন বগুড়াবাসীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। রেলে, সড়ক ব্যবস্থাপনায়, হাসপাতালে, সরকারি অফিসে প্রতিদিন মানুষ অন্যায়ভাবে নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভোক্তাস্বার্থ লংঘিত হচ্ছে। এইসব জনকষ্ট নিবারণের জন্য দৃঢ় ও দলনিরপেক্ষ পদক্ষেপ নেবার যথেষ্ট সুযোগ আছে। জেলা প্রশাসক সেই কাজে নেতৃত্ব দিতে পারেন। জনপ্রশাসন জনসেবা দিয়েই মানুষের হৃদয়কে জাগাতে পারে।

তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, বগুড়ার জেলা প্রশাসক নিজে কি এসব দোষ থেকে মুক্ত? কথায় আছে, সুশাসক হওয়ার আগে যাদের শাসন করবেন তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। ১৫ সেপ্টেম্বরের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে জলমহাল ইজারার টাকা’। বগুড়ার জেলা প্রশাসক যেদিন এই তরুণ-তরুণীদের সামাজিক অপরাধে দোষী করছেন সেদিনই সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে এমন আর্থিক দুর্নীতির কথা।

চার.
সমাজের সংশোধন দরকার। আইন প্রয়োগ তার একটা মাধ্যম বটে। তবে এটাও ভাবা দরকার, আইন প্রয়োগের আগে আরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না? বিশেষত কিশোর বয়সীদের বিষয়ে আরও সচেতন হয়েই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সাথে এটাও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন সমাজে যিনি অনিয়ম দূর করতে চান, সমাজে সংশোধন আনতে চান, তিনি নিজেও এসব দুষ্ট কর্মকাণ্ডে নিমজ্জিত কি না? আইনদণ্ড হাতে থাকলেই যত্রতত্র তার প্রয়োগ করা উচিত কি না সেই ভাবনাটা ভাবাও খুব জরুরি।


শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর