কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বর্তমানে নন-ফার্মাসিউটিক্যাল কৌশলই গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর | 2023-08-26 12:29:12

মানুষের রোগের জন্য দায়ী সাতটি করোনাভাইরাগুলোর মধ্যে কোডিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২ হচ্ছে সপ্তম প্রজাতি। ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-1 ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোডিড-১৯ এর ভাইরাস SARS-COV-2 এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ জেনেটিক সম্পর্ক আছে। সংক্রমণের সময় সার্স-কোভ-১ ও সার্স-কোভ-২ উভয় ভাইরাসই স্পাইক প্রোটিনের রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেন (receptor-binding domain) এর মাধ্যমে মানুষের কোষের একই রিসেপটর ‘hACE 2/এইচএসিই ২’ (হিউম্যান এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২) তে সংযুক্ত হলেও, এইচএসিই ২-তে সংযুক্ত হওয়ার জন্য সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের দুইটি হটস্পটস, সার্স-কোভ-১ ভাইরাসের দুইটি হটস্পটস এর তুলনায় মানুষের কোষের এইচএসিই ২ এর সঙ্গে বন্ধনে অধিকতর নিবিড় ও স্থিতিশীল। কোডিড-১৯ রোগের ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের হটস্পটগুলোর ভিন্ন গঠনের কারণে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের কোষের এইচএসিই-২’কে তীব্রভাবে আকর্ষণের মাধ্যমে দ্রুত সংক্রমণ ও বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখছে (সূত্র: ন্যাচার জার্নাল)।

কোডিড-১৯ রোগ সংক্রান্ত চীনের শীর্ষ গবেষক গাও এর মতে, সামাজিক শিষ্টাচার/শারীরিক দূরত্ব (social distancing) যে কোন সংক্রমণ বিশেষভাবে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যকীয় কৌশল (সূত্র: ২৭ মার্চ ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স নিউজ পেপার)। কোডিড-১৯ রোগের কোন মেডিসিন ও ভ্যাকসিন না থাকায় বর্তমানে বিশ্বের সকল আক্রান্ত দেশই নিম্নলিখিত ননফার্মাসিউটিক্যাল কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এই রোগকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে।

১। সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে অন্তত ২০ সেকেন্ড যাবত ঘন ঘন হাত পরিষ্কার।

২। মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার।

৩। মানুষদের নিরাপদে সামাজিক শিষ্টাচার/ শারীরিক দূরত্ব বা কোয়ারেন্টাইনে রাখা।

৪। গণ জমায়েত পরিহার।

যুক্তরাস্ট্র ও ইউরোপে কোডিড-১৯ রোগটি আবির্ভূত হলে, দেশগুলোর জনগণ মাস্ক না ব্যবহার করায় রোগটি বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ‘‘বড় ভুল’’ ছিল মনে করেন চীনের শীর্ষ গবেষক গাও। ইউ এস সার্জন জেনারেল (যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ডাক্তার) জেরম এডামস যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণকে মাস্ক "অপ্রয়োজনীয়" বলে না পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন (সূত্র: সিএনবিসি)। ইউ এস সার্জন জেনারেল শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক পড়ার পক্ষে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোডিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেলে ইউ এস সার্জন জেনারেল এডামস ২ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন) এর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন, পূর্বের সুপারিশ প্রত্যাহার করে সকল জনগণকে বাহিরে মাস্ক ব্যবহারের সুপারিশ করতে। দ্য জার্নাল এনালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, কোডিড-১৯ রোগের ভাইরাস যে কোন ব্যক্তিকে আক্রান্ত করার পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচ দিন সময় লাগে। সেকারণে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম পর্যায়ে অধিকাংশ মানুষ লক্ষনবিহীন (asymptomatic) থাকে। সম্প্রতি ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার প্রথম পাঁচ দিনে প্রতি মিলিলিটার থুতুতে (sputum) উচ্চমাত্রায় (সত্তর লক্ষ কপি ভাইরাস) এবং একইভাবে কফেও উচ্চমাত্রায় কোডিড-১৯ রোগের ভাইরাস বহন করে। এই মারণ ভাইরাস মূলত দুইভাবে, থুথু/হাঁচি/কাশির তরল ড্রপলেট এবং সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসটি বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর টিকে থাকতে সক্ষম। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, ভাইরাসটি বাতাস সহ অনেক মাধ্যমে টিকে থাকতে সক্ষম। সেকারণে ভাইরাসকে নির্মূল করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন) প্রথম থেকেই সাবান বা অন্তত ৬০% এলকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন প্রতিবার কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হ্যত পরিস্কার করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলি সাধারণ জনগণকে ‘‘মাস্ক’’ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছিল। তাঁরা লক্ষণবিহীন (asymptomatic) অবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে অবগত ছিলেন না।

কিন্তু চীনের কোডিড-১৯ রোগ বিশেষজ্ঞগণের প্রমাণ পেয়েছেন, লক্ষণবিহীন (asymptomatic) আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি না দিলেও, কথা বলার সময় মুখ দিয়ে যে থুথুর ড্রপলেট বের হয় তা ভাইরাস সংক্রমণে সক্ষম। অনাক্রান্ত ব্যক্তি মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করলে আক্রান্ত ব্যক্তির ভাইরাস বহনকৃত ড্রপলেট থেকে অনেকাংশে রক্ষা পায়। N95 মাস্ক ভাইরাসের ড্রপলেট থেকে ৯৫% সুরক্ষা দেয় এবং N99 মাস্ক ভাইরাসের ড্রপলেট থেকে ৯৯% সুরক্ষা দেয় (সূত্র: রয়টার্স)। “N” দ্বারা কমপক্ষে ০.৩ মাইক্রোন ব্যাসের ক্ষুদ্র কণা ব্লক করার শতকরা সম্পর্ক বুঝায়। সম্প্রতি সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) পরামর্শ দিয়েছেন, সার্জিকাল মাস্ক না পাওয়া গেলে জনগণকে যে কোন কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করার জন্য।

ক্রমবর্ধমান প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, শীতকালে কোভিড-১৯ রোগের প্রকোপ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত চলাফেরার উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বৈজ্ঞানিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিশেষজ্ঞ স্যান্টিল্যানা জানিয়েছেন যে, আবদ্ধ পরিবেশে যেখানে বায়ুচলাচল কম থাকে, সেখানে কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে (তথ্য সূত্র: ২৩ অক্টোবর, ২০২০ তারিখের বিশ্বখ্যাত “ন্যাচার” জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)। শীতে আবদ্ধ পরিবেশে মানুষ বেশি থাকে কারণ সকালে বা রাতে ঠান্ডার জন্য জানালা বন্ধ থাকে। বায়ুচলাচল কম থাকায় এটা শীতে বাড়তি ঝুঁকির একটি কারণ হতে পারে।শ্বসন স্বাস্থ্যবিধি (বিশেষত সামাজিক শিষ্টাচার/শারীরিক দূরত্ব ও মাস্ক ব্যবহার) না মেনে চললে শীতে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপক হবে।

ড. মু. আলী আসগর: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর