পেশা: সাবেক- সাংবাদিক, হাল-গুপ্তচর

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-26 11:08:57

অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে। আইনটি এখন কার্যকর। এ আইনের ধারায় এখন মামলা হতে পারে, যে কেউ গ্রেফতার হতে পারেন আর গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে কেউ কেউ অভিযুক্তও হতে পারেন। সেই সাথে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় যে সব মামলা হয়েছে তার কার্যক্রমও চলবে।

আইনটি পাস করার আগে সরকার অনেক অংশীজনের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছে। এই আইনের অন্যতম অংশীজন হচ্চেন দেশের সাংবাদিক। সাংবাদিকরা বলছেন, এ আইন কার্যকর হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে। ফলে এ আইন কার্যকর হলে সাংবাদিক সমাজই হবে অন্যতম সংক্ষুব্ধ শ্রেণি। আর সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম। সাংবাদিকরা দাবী করছেন, এ আইনের ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে আইনে গুপ্তচর বৃত্তি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। এতে করে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হবেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ফল যদি জেল-জরিমানা হয় তাহলে দেশে বাকস্বাধীনতার পথও রুদ্ধ হবে। যদিও সরকারের একাধিক মন্ত্রী সাংবাদিকদের আশ্বস্থ করেছেন যে আইনে তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং এতে মুক্তবাকের পথ আরো উন্মুক্ত হলো। সরকার বলছে মুক্ত বাক; কিন্তু সাংবাদিকরা বলছেন মুক্ত বাঘ। ভুলে গেলে চলবেনা, মুক্ত বাঘ সবার জন্যই বিপজ্জনক। আজ একজন এই বাঘের শিকার তো কাল আরেকজন এর শিকার। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা না পড়ালে কিন্তু একদিনই এই বিড়ালই বাঘ হয়ে আক্রমণ করে। সেদিন সে তার মা-মাসিকেও চেনে না। বিড়ালরূপী এরকম চটি আইনের উদাহরণ আমাদের দেশে অনেক আছে যা একসময় নিপীড়নের মহাকাব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আমাদের দেশে ব্রিটিশদের করা একটি আইন ছিল। ওই আইনের আসল উদ্দেশ্য ছিল সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য গোপন রাখার অধিকার। অফিসিয়াল সিক্রেসি আইনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় তথ্য নিরাপত্তার অজুহাতে জনগণকে তথ্য দিতে অস্বীকার করতে পারতো। এ আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ বহুদিন ধরেই আমরা দেখিনি। কিন্তু আমরা দেখলাম, হঠাৎ করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঢুকে পড়লো সেই পুরনো ‘বিটিশ গুপ্তচর’। ব্রিটিশ আইনের গুপ্তচররাই হালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাংবাদিক হিসেবে আবির্ভূত হলো। ১৯২৩ সালের ওই আইনে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ যুক্ত করার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামীদের দমন করা। এখনও সরকার স্বাধীনতার শত্রুদের দমন করতেই এ আইন করেছে। কোনটা গুপ্তচরবৃত্তি আর কোনটা সাংবাদিকতা তা নির্ধারণ করবে কে? তার চেয়েও বড় বিষয় এটি নির্ধারণের আগেই যে হয়রানির শিকার হবেন তার প্রতিকার কি? থানায় দৌড়া-দৌড়ি করেইতো সাংবাদিকের অবস্থা বেগতিক। গুপ্তচরবৃত্তি আর কখন করবেন?

আইনটি পাস হওয়ার পর দল-মত নির্বিশেষে সবাই একবাক্যে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সচেতন মহলের সবচেয়ে বড় ভয়, এ আইনের অপপ্রয়োগের ফলে দেশের আপামর জনসাধারণ হয়রানির শিকার হবে। মানুষকে ভয়ভীতি দেখাতে এই আইনের কোনো জুড়ি নেই। এর আগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারারও ব্যাপক অপপ্রয়োগ আমরা দেখেছি। রাজনৈতিক হয়রানির পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ একটি সাধারণ রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করলেও আইন শৃ্ঙ্ক্ষলা বাহিনীর কিছু অসাধু ব্যক্তি এর সুযোগ নিয়েছে। থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়েছ। মামলা হয়েছে অনেকের নামে।
আগের আইনের ওই ৫৭ ধারা বাতিল হয়েছে। কিন্তু মামলা এখনো চলছে। ফৌজদারী মামলার বিবাদী হয়ে এখনো কোর্ট-কাচারিতে দৌড়-ঝাপ করছেন। কবে এসব মামলা শেষ হবে তাও অনিশ্চিত।

কিন্তু ওই আইনের ৫৭ ধারাই নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ছদ্মবেশে বিভিন্ন ধারার মধ্যে লুকিয়ে আছে। বরং নতুন আইনের অনেক ধারাও যোগ হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বলছেন, এ আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, আইনে কি লেখা আছে যে এ আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে না? নাকি মামলা হলে অথবা পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে সাংবাদিকরা বলবেন যে মন্ত্রী বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে এ আইন প্রয়োগ করা হবে না। আর পুলিশ এ কথা শুনেই তাদেরকে জামাই আদর করে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। আর যদি সরকার বদল হয়, তবে বর্তমান মন্ত্রীর কথা পরের সরকারের মন্ত্রী শুনবেন কেন? এক মন্ত্রীর কথাই আরেক মন্ত্রী শোনেন না। আর অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসলেতো কথাই নেই। গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে সাবেক মন্ত্রীকেও ধরতে পারেন।

তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী সংসদে আরো বলেছেন, এ আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পথ খুলে দেবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য কোনো আইন দরকার হয় না। পৃথিবীর কোনো দেশেই মত প্রকাশের জন্য আইন লাগে না। মত প্রকাশের পথ রুদ্ধ করার জন্যই আইন লাগে। আগের আইন বেশি কঠোর হলে নতুন আইনে হয়তো কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি দেয়া হয় বড়জোর। কিন্তু আমাদের নতুন ডিজিটাল আইনে সেসব কিছুই করা হয়নি। বরং পুরাতন ধারার গায়ে আরো মাংস লাগিয়ে তাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শরীরে।

তবে এ দায় পুরোপুরি এ সরকারের নয়। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি আইন এ সরকার প্রণয়ন করেনি। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারই এ আইন পাস করেছে। এ আইনের উদ্দেশ্য ছিল বিরোধীদের দমন। নিয়তির পরিহাস! এক বছরের ব্যবধানে নিজেদের আইনে নিজেরাই ধরা।

ভারতেও এরকম একটি আইন হয়েছিল। সেটি সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জও করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট তা অসাংবিধানিক বলে বাতিলও করে দেয়। সরকারও তা মেনে নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে শত সমালোচনা থাকলেও এ আইন বাতিল করার কোনো পদক্ষেপ নেয়াতো হয়ইনি বরং আরো পাকাপোক্ত করে জুড়ে দেয়া হযেছে।

এ আইনের অনেক ধারাই আন্তর্জাতিক আইন, সুপ্রিম কোর্টের রায় এমনকি আমাদের সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এ আইনের অপব্যবহারের ঝুকি। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের যে মাত্রা দেখেছি তা যদি অব্যাহত থাকে তবে এ আইন একসময় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতোই হবে। আওয়ামী লীগ বিশেষ ক্ষমতা আইন করেছিল ১৯৭৪ সালে। কিন্তু ওই আইনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগই। জেল-জুলুম-হামলা-মামলার খড়গ তাদের ওপরই বেশি নেমে এসেছিল। আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। যে যার পেশা নিয়ে সহিহ সালামতে জীবিকা নির্বাহ করুক এটাই কাম্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর