অগ্নিগর্ভ মিয়ানমারে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা পাবে না আর্মি

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 02:52:07

পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষের সেনা অভ্যুত্থানের পর মাসের শেষ দিনটি সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতিতে পাড়ি দিল মিয়ানমার। তারপর মার্চ মাস শুরু হয়েছে চরম বিক্ষোভ, উত্তেজনা এবং সেনা ও জনতার মুখোমুখি অবস্থানের মধ্য দিয়ে।

গণতন্ত্রের দাবিতে দেশটির প্রধান শহরগুলো উত্তপ্ত। চলছে আর্মি বিরোধী গণআন্দোলন। আন্দোলন থামাতে বিচ্ছিন্ন গুলির বর্ষণের ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। আন্দোলনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ইয়াংগুন, ডাউয়ি, মান্ডালে, মেয়িক, বাগো ও পোকোক্কু শহরে। আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। রোববারের (২৮ ফেব্রুয়ারি) হত্যা ও রক্তপাতের প্রতিক্রিয়ায় সোমবার (১ মার্চ) আরো তীব্র প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী জনতা।

আন্তর্জাতিকভাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে কারো ধারণাই স্পষ্ট ছিলনা। মনে করা হয়েছিল, আর্মি প্রকৃতই একটি ভালো নির্বাচন দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবে। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখোশের আড়াল থেকে আর্মির আসল চেহারা বের হয়ে আসে। পরিস্কার বোঝা যায় যে, সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতা দখলই আর্মির মতলব। সমানে গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে দেশকে রাজনীতিবিদ শূন্য করার প্রচেষ্টা দেখে দেশটির মানুষ সামরিক শাসনকে একেবারেই মেনে নিতে চায় নি।

চীনও আরো কয়েকটি দেশের নিরপেক্ষ থাকা বা আর্মিকে কাজ করতে দেওয়ার মনোবৃত্তি প্রকাশ পেলেও জাতিসংঘ, আমেরিকা ও অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ মিয়ানমারের সামরিক শাসনের সরাসির  নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। গণতান্ত্রিক ক্ষমতা দখলকারী সামরিক কর্তৃপক্ষকে শায়েস্তা করতে অবরোধসহ নানা রকমের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে দাবিও উত্থাপিত হচ্ছে নানা দেশের পক্ষ থেকে।

সামরিক শাসনের অতীত অভিজ্ঞতার সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা মিয়ানমারের গণতন্ত্রের যাত্রা কখনোই বিশুদ্ধ ছিলনা। ছিল সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত। সেই সামরিক বাহিনী সুযোগ মতো ক্ষমতা দখলের ঘটনাটিও দেশটির জন্য আশ্চর্যজনক নয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, অতীতের মতো এবার সামরিক শাসনকে সহজে মেনে নেয়নি মিয়ানমারের জনগণ। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পরেই তীব্র আন্দোলন পুঞ্জিভূত হয় দেশময়। এক মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি রক্তাক্ত ও অগ্নিগর্ভ আকার ধারণ করে এবং জনতা ও সামরিক বাহিনী মারমুখী ও মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে।   

মিয়ানমারে এখন প্রতিদিনই নানা শহরে নানা মাত্রায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চলছে জনতার পক্ষ থেকে। পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ সরাসরি গুলি, কাঁদানে গ্যাস, স্টান গ্রেনেড ছুড়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্রমেই আগ্রাসী হচ্ছে বিক্ষোভ আর বিরোধী দমনপীড়ন হচ্ছে আক্রমণাত্মক।

শুধু সাধারণ জনগণই নয়, আর্মির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন মিয়ানমারের পেশাজীবী সমাজ। চিকিৎসক একদিকে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছেন, আবার অন্যদিকে ইয়াঙ্গুনে জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহতদের চিকিৎসা করছেন। শিক্ষক, প্রকৌশলী ও আইনজীবীদের বিরাট অংশ আন্দোলনের মাঠে অবস্থান করছেন। আগে থেকেই ছাত্র আছে আন্দোলনের সামনের কাতারে। তাদের পাশে রয়েছেন নারী সমাজ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা যায় ইয়াঙ্গুনে লোকজন রক্তাক্ত ব্যক্তিদের নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছে। কোথাও কোথাও মানুষকে রাস্তায় নিথর পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর মতোই অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ চলছে ইয়াঙ্গুনের আশপাশে, যার প্রতিটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছেন।

যারা রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন তাদের অনেকেই গ্যাসবিরোধী মাস্ক, মাথায় হ্যাট এবং চোখে চশমা পরিধান করছেন। তাদের বিরুদ্ধেও পুলিশ কড়া জবাব দিচ্ছে। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে। রাষ্ট্র পরিচালিত এমআরটিভি টেলিভিশনের মতে, 'প্রতিদিনই বিক্ষোভ থেকে কমপক্ষে ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।'

তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য থেকে প্রকাশ, সরকারি গ্রেফতার ও নিপীড়নের পরেও মিয়ানমারের বড় বড় শহরের অধিবাসীরা দ্রুত রাস্তা ব্লক করে অস্থায়ী তাঁবুতে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছেন। তারা ফুটপাতের স্লাব তুলে, ময়লা রাখার বিন তুলে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, যাতে পুলিশ তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারে। জনতার সঙ্গে রয়েছেন সামরিক শাসন বিরোধী পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার।

প্রায় ৫০ বছরের সামারিক শাসনের পর মিয়ানমার অতি সম্প্রতি গণতন্ত্রের পথে এক পা দু’পা করে হাঁটা শুরু করেছিল। কিন্তু ক্ষমতালোভী সামরিক বাহিনী তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আবার। তারা কেড়ে নিয়েছে গণতন্ত্র। এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছেন সর্ব স্তরের মানুষ। ক্ষুব্ধ জনতা আর্মিকে মোটেও মেনে নিচ্ছেনা। অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। কিছু দেশ এরই মধ্যে সীমিত আকারে অবরোধ দিয়েছে। তবে জান্তার পক্ষে সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে কোনো কোনো দেশের। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক শাসনের পক্ষে-বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এইসব মেরুকরণ ক্রমেই তুচ্ছরূপে প্রতিভাত হচ্ছে।

কারণ, দেশটির জনগণ ফুঁসে উঠেছে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং তারা দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যনিয়ন্তার আসন গ্রহণ করেছে।। অতীতের মতো এবার সামরিক শাসনের ব্যাপারে নিশ্চুপ বা মৌন সমর্থন নেই জনগণের কোনো অংশেই। তাই এবারের সামরিক সরকার, বাইরের কোনো কোনো পক্ষের মদদ পেলেও জনগণের সুতীব্র অসম্মতি ও প্রতিরোধের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা দখলের পথে আদৌ কোনো সফলতা পাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর