রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইইউর দ্বৈততা

, যুক্তিতর্ক

ড. প্রণব কুমার পান্ডে | 2023-09-01 16:56:07

সম্প্রতি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত "ইইউ মিয়ানমার পুলিশ ইউনিটগুলোকে ভিড় নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে" শীর্ষক একটি প্রতিবেদন দেখে আমি হতবাক হয়েছি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ইইউ পুলিশ গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের উপর সহিংস ক্র্যাকডাউনে জড়িত বিশেষজ্ঞ মিয়ানমার পুলিশ ইউনিটগুলিকে ভিড় নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ইউরোপীয় পুলিশ এবং মিয়ানমার পুলিশ উভয়ই "মাইপোল" প্রকল্কের আওতায় ভিড় নিয়ন্ত্রণের কৌশলের উপর ম্যানুয়াল তৈরির জন্য একসাথে কাজ করবে। এই সংবাদটি সত্যিই আমাকে হতাশ করেছে কারণ পুলিশের এই সকল সদস্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর সহিংস নৃশংসতা চালানোর সাথে জড়িত ছিল। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইইউর দ্বৈত নীতি প্রতিফলিত হয়েছে।

যেমনটি আমরা সবাই জানি, মিয়ানমার সরকারের নৃশংসতা ও সহিংস নির্যাতন থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার ও আশ্রয় দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে সীমান্ত খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।  রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সীমান্ত খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করেছিল, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যাপক প্রশংসা করেছিল। তবে আশঙ্কা ছিল যে শেখ হাসিনার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে এই জনগোষ্ঠী একবার দেশে প্রবেশ করলে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের দায়বদ্ধতায় রূপান্তরিত হতে পারে। এটি এই কারণে ধারণা করা হয়েছিল যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নতুন ছিল না। শেখ হাসিনার মানবিক সিদ্ধান্তের কারণে মূলধারার ব্রিটিশ মিডিয়া তাঁকে "মানবতার জননী" উপাধিতে ভূষিত করে।

আমাদের দেশে এই ইস্যুটিকে ঘিরে দ্বিধা সৃষ্টি হতে শুরু হয় যখন থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ধীরে চলা নীতি অবলম্বন করে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি জাতিসংঘ এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলোসহ বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যে প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকার এই সঙ্কট পরিচালনার করছে তারা তার বিরোধিতা করেছে। রোহিঙ্গা প্রবাহের প্রাথমিক দিনগুলিতে মিয়ানমার সরকার এই বিষয়ে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানালেও তারা আন্তর্জাতিক চাপে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ শুরু করে। বেশ কয়েক দফা আলোচনার ফলস্বরূপ, ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লুজি) গঠিত হয় এক মাস পরে। দুর্ভাগ্যক্রমে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তনের অনীহা এবং এই সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের অনীচ্ছার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি আলোর মুখ দেখেনি। তবে বাংলাদেশ সরকার প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমন শুরুর পর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন শরণার্থীদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং উন্নত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সোচ্চার ছিল। তারা বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এ লক্ষ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এমনকি, বাংলাদেশ সরকারকেও এই সম্প্রদায়ের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল দেখা গেছে। যার ফলশ্রুতিতে, এই জনগোষ্ঠীর উন্নত জীবন-মান নিশ্চিত করার জন্য ভাসান চরে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক লক্ষ রোহিঙ্গার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধসহ বাড়ি তৈরির একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন সমাপ্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভাসান চরে স্থান্তাতর প্রক্রিয়া কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছে। এই স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠী নতুন আবাসনসহ সকল সুযোগ-সুবিধায় অত্যন্ত খুশী।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্থানান্তরণের প্রক্রিয়া শুরু হলে, ইইউসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো ভাসান চরে বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। তবে, ভাসান চরে সাম্প্রতিক অতীতে এমন বিপর্যয়ের কোনও ঘটনা ঘটেনি। রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত ভাসান চরের সুবিধাগুলি পরিদর্শনের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার  প্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া যায় নি। শারীরিকভাবে স্পটটি না দেখে, অনেক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভাসান চর সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছে যা মোটেও কাম্য নয়। সুতরাং, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বদেশ প্রত্যাবাসন থেকে ভাসান চরে স্থানান্তরকরণে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক কোন সংবাদ নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন সহজতর করার জন্য মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার প্রয়োজন থাকলেও ইইউ মিয়ানমার পুলিশকে ভিড় নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে,  যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। এই দেশগুলো মুখে সর্বদা মানবাধিকারের কথা বলে এবং রোহিঙ্গা প্রবাহের প্রাথমিক পর্যায়ে তারা একই ভূমিকা পালন করেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বর্বরতা চালানোর প্রক্রিয়াতে সরাসরি জড়িত পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। তাদের উচিত দ্বৈত ভূমিকা পালন করা থেকে বিরত থেকে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা এই গৃহহীন মানুষদের তাদের জন্মভূমিতে সম্মানের সাথে ফেরত নেয়।

বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতীত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শীঘ্রই শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত এই বাস্তুহারাজনগোষ্ঠীর দুর্দশা অনুভব করে মিয়ানমার সরকারকে সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে এই গৃহহীন মানুষদের সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনের বিভাগের প্রফেসর ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর