আত্ম-বিবাচনের উপাখ্যান

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ইকরাম কবীর | 2023-08-28 03:33:25

‘সেন্সর’ শব্দের বাংলা তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। সারাজীবন শুধু ‘সেন্সর’ই শুনেছি। ‘সেন্সর’-এর বাংলা শুনিনি। ‘সেলফ-সেন্সর’-এরও বাংলা পাওয়া যায় না। যতদূর মনে পড়ে এগুলোর ইংরেজি শব্দই সবসময় আমরা ব্যবহার করে এসেছি। অবশেষে একটু চেষ্টাআত্তি করে আবিষ্কার করলাম যে, ‘সেন্সর’কে বিবাচন ও ‘সেলফ-সেন্সর’কে আত্ম-বিবাচন বলা যেতে পারে। যদিও কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আমি নেইনি, তবুও ব্যবহার করেই ফেললাম আমার এ লেখায়।

ছোটবেলায় দেখতাম ‘চিত্রালী’ ও ‘পূর্বানী’ নামের দু’টি সিনেমার পত্রিকা ছিল। সেগুলোর বরাতেই শিখেছিলাম ‘সেন্সর’ শব্দটি। তখন আট-ন’বছর বয়স। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর-পর। তখনই পরিচয় হয়েছিল ‘সেন্সরবোর্ড’ শব্দের সঙ্গে। মা বুঝিয়েছিলেন ‘সেন্সরবোর্ড’ সরকারের তৈরি করে দেয়া একটি পর্ষদ যার সদস্যরা বসে বসে লক্ষ্য রাখেন সিনেমা, পত্রিকা ও বইপত্রের দিকে এবং খেয়াল রাখেন যা-যা দেশের নাগরিকরা বলেন তা দেশবিরোধী বা সমাজবিরোধী হয়ে যাচ্ছে কিনা। যদি হয়, তাহলে পর্ষদ তা বাদ দিয়ে প্রকাশ করতেন।

সিনেমা দেখতে গিয়ে দেখতাম একটি চিত্র আরেকটি চিত্রে সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না। মায়ের পাশে বসেই বুঝতাম ‘সেন্সর’ হয়েছে। ‘সেন্সর’ শব্দের অর্থ বুঝে গেলাম ‘বাদ দেয়া’, ‘মুছে দেয়া’, বা ‘কেটে দেয়া’, বা ‘না দেখতে দেয়া’, বা ‘না বলতে দেয়া’। কিন্তু এ শব্দগুলো সব মনে মনে ভেবে নেয়া শব্দ।

সবাই ‘সেন্সর’ শব্দটিই বলতেন; ‘সেন্সর’-এর কোনো বাংলা শব্দ কখনও বলতে শুনিনি। জেনেই এসেছি ‘সেন্সর’ মানে ‘বাদ দেয়া।’ অনেক ইংরেজি ছবিও দেখতাম। ইংরেজি সিনেমায় ‘বাদ দেয়া’ বা সিনেমার ‘রীল কেটে দেয়া’ আরো স্পষ্ট বোঝা যেত। নায়ক-নায়িকা একে-অপরের কাছাকাছি আসতে দেখলেই হল-কর্তৃপক্ষ ছবি কেটে দিতেন এবং তা পরিস্কার বোঝা যেত। নায়ক-নায়িকা কাছাকাছি এসে যা-যা করতেন, তা বাদ দিয়ে করা শেষ করলেই আবার ছবি আমাদের চোখের সামনে চলে আসতো। মনে মনে ভাবতাম এসব দৃশ্য আগে থেকে কেটে ফেললেই তো হয়! আর এসব সিনেমার অংশ করারই বা প্রয়োজন কি?

সেই ছোটবেলার সেন্সর শব্দটি অনেকগুলো বছর আমার সামনে আসেনি। তবে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে ‘সেন্সর’ শব্দটির সঙ্গে আমার পুণঃমোলাকাত হয়। সাংবাদিকরা খবর খুঁজে বেড়ান– ভালো, খারাপ ও কুৎসিত। প্রায় সবই ছাপা হয়, তবে মাঝে-মাঝেই কিছু খবর ছাপা হয় না। সেন্সর করে দেয়া হয়। কখনও বার্তা সম্পাদক করেন, কখনও বা সম্পাদক করেন। অনেক ক্ষেত্রে সরকার বিরোধী তথ্য প্রকাশ করা যায় না; অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে কিছু প্রকাশ করা যায় না। এমন অনেক ঘটনা দেখেছি।

এক সময় একটি ইংরেজি দৈনিকে সম্পাদকীয় লিখতাম। চেয়ে-চিন্তে কাজটি পেয়েছিলাম, কিন্তু খুব ভালো লিখতে পারতাম না; যা বলার প্রায় সরাসরি বলে ফেলতাম। তবে সরাসরি যে কিছু বলতে হয় না তা বুঝতাম না। সেই পত্রিকার একজন সহযোগী সম্পাদক প্রায়ই আমায় লেখা শেখাতে বসতেন। বলতেনঃ ‘শোন, সাংবাদিকতা সবকিছু প্রকাশ করার জন্যে নয়, সাংবাদিকতা হচ্ছে তুমি কত সুন্দর করে তোমার চিন্তাটি লুকিয়ে প্রকাশ করতে পারো, সেই শিল্প।’

আমি অবাক হতাম আর ভাবতাম এরা সবাই সেলফ-সেন্সর্ড সাংবাদিক। তবে তারা বলতেন দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা।

মনে পড়ে ২০০৮ সালে ধর্মের আলোকে বহুবিবাহ নিয়ে একটি সেমিনার হয়েছিল। সেমিনারে আলোচনা হয়েছিল যে আসলে কোরআনে একের অধিক বিয়ে করা মানা করা হয়েছে। যেখানে চার বিয়ের উল্লেখ আছে, সেখানে এতিমদের একটি প্রেক্ষাপট দিয়ে বলা হয়েছে যে, চার বিয়ে করা সম্ভব যদি কোনো পুরুষ মনে করে যে সে চারজন স্ত্রীর সঙ্গে একেবারে সমান ব্যবহার করতে পারবে। এই সূরাতেই কিছুক্ষণ পরই বলা হয়েছে যে, ‘দু’জন স্ত্রীর সঙ্গেই সমান ব্যবহার করা সম্ভব নয়।’ পরিষ্কার বলা রয়েছে। আমি লিখলাম যে আসলে বহুবিবাহকে ইসলাম ধর্ম সমর্থন করেনি। আমরা, পুরুষরা প্রথম আয়াতটি নিয়ে আমাদের সুবিধামতো ব্যবহার করে এসেছি।

লেখাটি পাঠালাম সবচেয়ে বড় ইংরেজি কাগজের ম্যাগাজিন বিভাগে। ম্যাগাজিনের সম্পাদক আমার বন্ধু; একসাথে ওই পত্রিকায়ই কাজ করেছি বেশ ক’বছর। সে পড়ে বললো যে লেখাটি তারা ছাপাতে পারবে না; সাহস পাচ্ছে না। আমি বলি, ‘আমাদের কোরআনের উদ্ধৃতি দেয়া আছে; ভয় কিসের? কোরআন বললে ভয় করবে কেন?’ সে বললো, ‘সমাজকে ভয়’।

আমি অনেকদিন– প্রায় তিন বছর লেখাটি নিয়ে বসে রইলাম। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘কে বলেছে চার বিয়ে করা যায়?’ অবশেষে ঢাকা ট্রিবিউন নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হল এবং তারা আমায় তাদের পত্রিকায় কলাম লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমি তাদের এই লেখাটির কথা বলতেই তারা নিয়ে ছেপে দিলেন। শিরোনামটি অবশ্য বদলে দিয়েছিলেন। ঢাকা ট্রিবিউনকে ধন্যবাদ লেখাটি ছাপার জন্য।

আরেকটি লেখার কথা বলি। এ বছরই লিখেছিলাম। শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘মানুষই মানুষকে মারবে’। লেখার ধারণাটি পেয়েছিলাম বিবিসি ফিউচারে একটি ফিচার পড়ে। বিবিসি কল্পনা করতে চেয়েছিল যে পৃথিবী থেকে হঠাৎ একদিন যদি আগ্নেয়াস্ত্রগুলো উধাও হয়ে যায় তাহলে কী হতে পারে। খুব আগ্রহ নিয়ে লেখাটি পড়তে শুরু করলাম। বেশি খুশি হতে পারিনি। শিরোনামে যা ছিল তার কিছুই ভেতরে ছিল না। আসলে লেখাটি ছিল আমেরিকা নিয়ে। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রে কত মানুষ মারা যায় তা নিয়ে; কত মানুষ আত্মহত্যা করে তা নিয়ে।

অবশেষে আমি নিজেই লিখলাম– লিখলাম যে পৃথিবীতে আগ্নেয়াস্ত্র না থাকলেও মানুষ মানুষকে মারবে, খুন করবে, রক্ত ঝরাবে; গলা টিপে মারবে, ছুরি-চাকু দিয়ে মারবে, বর্শা দিয়ে মারবে- ঠিক যেমনটি ছিল আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কারের আগে। বেশ অনেক উদাহরণও দিলাম। আমি বিখ্যাত একটি অনলাইন পত্রিকায় কলাম লেখি। পাঠালাম সম্পাদকের কাছে। কিন্তু তিনি লেখাটি নিয়ে প্রায় সাতদিন বসে রইলেন। সাতদিন পর জানতে চাইলাম তিনি লেখাটি ছাপছেন না কেন। তিনি জানালেন, লেখাটি ছাপতে তিনি সাহস পাচ্ছেন না।

এমন আত্ম-বিবাচনের উদাহরণ আমি আরো পরিবেশন করতে পারি। আজকের লেখাটির ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না; বার্তা২৪.কম ছাপবে কিনা আমি জানি না, তবে এটুকু জানি যে আমাদের– সাংবাদিকদের এবং লেখকদের– যতটা না বিবাচিত করা হয়, তার চেয়ে বেশি বিবাচিত আমরা নিজেরাই। আমরাই আমাদের ঠেকিয়ে রাখি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর