করোনা, বইমেলা, বই সংস্কৃতি

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 15:12:58

করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সীমিত আকারে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, বিলম্বিতভাবে ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) থেকে। এদিনই আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ ‘দ্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল’-এ এলিজাবেথ বার্নস্টেইন ‘দ্য থেরাপিটিক ভ্যালু অব রিডিং’ শিরোনামে বৈশ্বিক মহামারিকালে গ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ কলাম প্রকাশ পেয়েছে, যাতে বই সংস্কৃতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চসমূহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

এলিজাবেথ দীর্ঘ বছর ধরে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল’-এ ‘বন্ডস: অন রিলেশনশিপস’ নামের একটি কলামে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের হর্ষ ও বিষাদ, মানসিক উত্থান-পতন, মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আলোচনা করছেন। আমেরিকার মিয়ামিতে বসবাসকারী এই ভদ্রমহিলার লেখা আমি প্রায়ই পড়ি এবং সেসব বিষয়ে কদাচিত তার সঙ্গে ই-মেইলে আলোচনাও করি। সুইমিং, স্কুবা ড্রাইভিং, রিডিং ও ট্র্যাভেলে আগ্রহী এলিজাবেথ তার লেখার তথ্য ও যুক্তি নিয়ে খুবই আন্তরিক ও সিরিয়াস, তার লেখা পড়ার মাধ্যমে এবং তার সঙ্গে যোগাযোগের আলোকে সে আস্থা আমার হয়েছে।

‘দ্য থেরাপিটিক ভ্যালু অব রিডিং’ শিরোনামের লেখাটিতে এলিজাবেথ জোর দিয়েছেন, বৈশ্বিক মহামারিকালে মানসিক শক্তি ও শান্তি বজায় রাখার জন্য বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে। নাতিদীর্ঘ লেখাটিতে তিনি বই পাঠ যে মস্তিষ্কের জন্য ভালো এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক, সেসব কথা বলেছেন। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের নানা সংজ্ঞা, তথ্য, পরিসংখ্যান ও উপাত্তের নিরিখে তিনি সঙ্গরোধের একাকীত্বে বই ও পড়াকে চিহ্নিত করেছেন পরম বন্ধু রূপে।

বই সংস্কৃতির নবতর বিন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমা দুনিয়ায় বৈশ্বিক মহামারি আক্রান্ত ২০২০ সালে অতীতের রেকর্ড ভেঙে সর্বাধিক বই বিক্রি হয়েছে। আত্মজীবনী, শিশু সাহিত্য, ফিকশন, নন-ফিকশন বইয়ের চাহিদা বেড়েছে। ট্র্যাডিশনার বই বিক্রির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনলাইন বিপণন ও ই-বুকের চাহিদা। অনেক অপ্রথাগত লেখকেরও উদ্ভব হয়েছে এ সময়কালে, যারা বিচিত্র বিষয় ও অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।

এলিজাবেথ তার লেখায় বই সংস্কৃতির পক্ষে কমপক্ষে দশটি কারণ চিহ্নিত করেছেন, যেজন্য বই পড়া দরকার। বিশেষত, সঙ্কটে, বিপদে, বিষন্নতায়, নিঃসঙ্গতায় পছন্দের বই, জ্ঞান ও চিন্তা উদ্দীপক বই বেশি বেশি পড়া প্রয়োজন, যার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিকতার নেতিবাচক চাপ ও আঘাত সহ্য করা যায় এবং চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলার ইতিবাচক শক্তি পাওয়া যায়।

সম্ভবত এসব মনো-জাগতিক প্রয়োজনের কথা সামনে রেখেই পশ্চিমা জগতে বিরাট পাঠক গোষ্ঠী, নিবিড় পাঠ আবহ ও বই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বাসায়, পথে, ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, প্লেনে মানুষ ফালতু প্যাঁচালে লিপ্ত না হয়ে বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ বই পড়েন এবং লক্ষ লক্ষ কপি বই বিক্রি হয়।

শব্দ দূষিত বাংলাদেশের সঙ্গে সে পরিস্থিতির তুলনা করাও বাতুলতা। বাংলাদেশে নিরবে থাকার সামান্য একখণ্ড জায়গা বা স্পেস খুঁজে পাওয়াও প্রায়-অসাধ্য বিষয়। পাবলিক প্লেসে হট্টগোল, চীৎকার নৈমিত্তিক বিষয়। সাধারণ গণপরিবহণের মতো অভিজাত বাস ও প্লেনে বর্বরের মতো উচ্চস্বরে কথা বলতে লোকজন অভ্যস্ত। ভ্রমণের বা বিনোদনের স্থানেও দু’দণ্ড শান্তিতে বসার জো নেই হৈচৈ-এর কারণে। এমনকি, ধর্মস্থানে পবিত্রতা আর নিরবতা বিঘ্ন করে উচ্চ কলবর সৃষ্টির বিষয়টিও এদেশে নজর এড়ায় না। বাসা-বাড়িতেও উচ্চস্বরে টিভি, সিনেমা, সিরিয়াল চলে। ফলে পড়ার পরিবেশ পাওয়াই এক কষ্টকর বিষয়। অতএব পাঠ সংস্কৃতি বিকাশের বদলে ক্ষুণ্ন হওয়াই স্বাভাবিক ঘটনা এদেশের পটভূমিতে।

পাঠের করুণ দশা টের পাওয়া যায় বই বিক্রির হার দেখে। পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে লক্ষ বা হাজার কপি বিক্রি হয়, সেখানে এদেশে খুব কম বই আছে, যেগুলো কয়েক শ কপি বিক্রি হয়। মোটামুটি ৩০০/৪০০ কপি বিক্রি হলেই প্রশাসকরা এদেশে সন্তুষ্ট হন এবং লোকশানের কবল থেকে রক্ষা পান।

এমন পরিস্থিতিতে নানা তর্ক-বিতর্কের পরেও বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। কত বই বের হয়, সেগুলোর গুণ ও মান কেমন, সেসব আদৌ বিক্রি হয় কি হয় না, এসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও বলা যায়, বইমেলা বইয়ের চাহিদা ও আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। পরোক্ষে হলেও পাঠককে প্রণোদিত করে। ফলে বইমেলাকে প্রকাশনা ও পাঠের নিরিখে কতটুকু কার্যকর করা যায়, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া দরকার।

করোনার চ্যালেঞ্জের মধ্যে বইমেলার আয়োজন নিঃসন্দেহে সাহসী উদ্যোগ। প্রকাশকরাও আর্থিক ক্ষতির চিন্তা মাথায় রেখেই মেলায় অংশ নিচ্ছেন এবং বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য বই প্রকাশ করছেন। ফলে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে সহায়তামূলক আচরণ করা। কারণ, মেলার সঙ্গে জড়িত আছে একুশের চেতনা ও বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির ঐতিহ্য। একই সঙ্গে রয়েছে বই পড়ার সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করার দায়িত্ব। বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উত্তীর্ণ করতে এসব কাজে এগিয়ে আসা জরুরি।

. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর