করোনাকে ভয়ও নয়, হেলাও নয়

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-09-01 17:02:11

ঠিক একবছর আগের মেরুদণ্ড শীতল করা ভয়টা যেন আবার ফিরে আসছে। গত মঙ্গলবার রাতে আমার এক আত্মীয় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। একই সঙ্গে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে থাকে আশঙ্কাজনকভাবে। মাস তিনেক আগে তার তার করোনা হলেও এবার আর টেস্ট করানো হয়নি। সন্তানরা রাতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু তিনটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো গিয়েছিল। কিন্তু কপাল খারাপ পরদিন সকালেই ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটের আইসিইউতে আগুন লাগে। কিন্তু সেই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ডাক্তাররা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। আবারও মাকে নিয়ে রাস্তায় নামেন সন্তানরা। শেষ পর্যন্ত উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের আইসিইউতে তার ঠাঁই হয়েছে। রোগীর স্বজনদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ, দৌড়াদৌড়ি, ফোনাফুনির পরও তিনি ষষ্ঠ হাসপাতালে থিতু হতে পেরেছিলেন। কিন্তু সন্তানরা তাদের মাকে বাঁচাতে পারেননি। ডাক্তারদের শত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মারা যান তিনি। আমার অভিজ্ঞতা যা বলে, পথে পথে ঘুরে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যেতে পারতেন তিনি। তবে যদি শুরুতেই কোনো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতেন, যদি সময়মত আইসিইউ সাপোর্ট পেতেন; হয়তো এ দফা বেঁচে যেতে পারতেন। যেহেতু তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাই তাকে কোভিড রোগী বলে সন্দেহ করা হয়। তাই তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়নি। আবার যেহেতু করোনা টেস্ট করা নেই, তাই করোনা ওয়ার্ডেও ভর্তি করা হয়নি। একদম একবছর আগের হযবরল অবস্থা। তার মানে একবছর আগের অব্যবস্থাপনা থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই নেইনি। আবার আমাদের গোড়া থেকে শুরু করতে হবে মনে হচ্ছে।

গতবছর ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। আর প্রথম মৃত্যুর খবর এসেছিল ১৮ মার্চ। চীনের উহানে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর শনাক্তের পর করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে আসতে সময় নেয় প্রায় আড়াই মাস। এই আড়াই মাস ছিল আামাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু সত্যি কথা বললে, আমরা সেই সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারিয়েছিলাম। আমরা আসলে কোনো প্রস্তুতিই নেইনি। তখন স্বীকার না করলেও করোনার বর্ষপূর্তিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে অব্যবস্থাপনা ছিল বলে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন এবং সমালোচনা করেন। কিন্তু আমি তো বলবো, তখন তো কোনো ব্যবস্থাপনাই ছিল না, অব্যবস্থাপনা তো দূরের কথা। নতুন একটি মহামারী নিয়ে সারাবিশ্বই বিপর্যস্ত ছিল, কোথাও কিছু বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না, কোনো উপকরণ পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপরও আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় এসব মোকাবিলা করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে এসেছি, যার প্রশংসা মিলছে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায় থেকে।‘ শুরুর নানান অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতার পর একটা স্থিরতা এসেছিল। প্রশংসাও এসেছিল। কিন্তু সেই প্রশংসা ধুয়ে পানি খেলে তো আর করোনা যাবে না। করোনা মোকাবিলায় আমাতের যেটুকু অর্জন সেটুকু ধরে রাখতে হলে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে কৌশল প্রণয়ন করে মাঠে নামতে হবে।

করোনা কেন আবার বাড়ছে, তা নিয়ে নানান আলোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা নানান ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে টিকার কার্যকারিতা নিয়েও। তবে আমার ধারণা করোনার শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার পেছনে আমাদের দায়ই বেশি। সংক্রমণ কমে আসা এবং বিশ্বের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে টিকা পেয়ে যাওয়া সামগ্রিকভাবে এক ধরনের আত্মতুষ্টি গ্রাস করে নেয় আমাদের। সবকিছুতে ভর করে শিথিলতা। আর এই শৈথিল্যের ফাঁক গলেই হয়তো করোনা ফিরে এসেছে নতুন করে।

টিকার পাশাপাশি এখন করোনা মোকাবিলায় নতুন করে পরিকল্পনা করে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নামতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১২ দফা সুপারিশ তৈরি করেছে। সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে নতুন করে মাঠে নামতে হবে, যাতে করোনা ছড়িয়ে যেতে না পারে। অধিদপ্তরের প্রথম সুপারিশ হলো- সম্ভব হলে কমপ্লিট লকডাউনে যেতে হবে। সম্ভব না হলে ইকোনমিক ব্যালান্স রেখে যে কোনো জনসমাগম বন্ধ করতে হবে। কমপ্লিট লকডাউন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। কারণ করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ও বাংলাদেশে লকডাউন হয়নি। ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল মাত্র। তবে কমপ্লিট না হলেও করোনো ম্যাপিং করে আঞ্চলিক লকডাউনের কথা ভাবা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাঁচা বাজার, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, শপিংমল, মসজিদ, রাজনৈতিক সমাগম, ভোট অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, পবিত্র রমজান মাসের ইফতার মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান সীমিতের সুপারিশ করেছে। এই উদ্যোগটি আরো অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু করোনা একটু কমতেই আমরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে আগের  মত সবকিছু করা শুরু করেছি। তাইতেই করোনা ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে। তবে এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি। কমপ্লিট লকডাউন না হলেও সবধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক সমাবেশ পরিহার করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং বিসিএস, এসএসসি, এইচএসসি, মাদ্রাসা, দখিলসহ সবধরনের পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন জটিল হবে। এরইমধ্যে সারাদেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এছাড়া আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা; এন্ট্রি পয়েন্টগুলোতে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, সবধরনের সভা ভার্চুয়াল করা, ঈদের ছুটি কমিয়ে আনারও সুপারিশ করেছে। এছাড়া পর্যটন এলাকায় চলাচল সীমিত করারও সুপারিশ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুপারিশগুলো করোনা মোকাবিলায় একদম বেসিক নিয়ম। কিন্তু আমি জানি, এই সুপারিশগুলো মানা হবে না। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানলে লকডাউনের দরকার হবে না। তার মানে অধিদপ্তরের সুপারিশ মন্ত্রণালয়ই মানছে না। তাহলে দেশের মানুষ মানবে কেন? তবে আমরা সবাই এরই মধ্যে জানি, করোনা মোকাবিলায় সবার আগে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। প্রথম কথা হলো, মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোনো জনসমাগমে যাওয়া যাবে না। পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ন্যূনতম নিয়মগুলো না মানলে ঝুঁকিতে পড়ে যাবেন আপনি। সরকার সবকিছু নাও করতে পারে। কিন্তু নিজের জন্যই আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। স্কুল বন্ধ। তাই আপনি যদি দল বেধে কক্সবাজার চলে যান, তাহলে স্কুল বন্ধ রাখার সুবিধাটা আপনি পাবেন না। বরং নিজের জন্য এবং আশেপাশের সবার জন্য ঝুঁকি তৈরি করবেন। মনে রাখবেন আপনি সরকারের কাছে শুধুমাত্র একটি সংখ্যা, কিন্তু আপনার প্রিয়জনদের কাছে আপনিই পুরো পৃথিবী।

করোনাকে ভয় যেমন পাওয়া যাবে না। আবার করোনাকে হেলাও করা যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সাথে করোনা মোকাবিলা করতে হবে।

লেখক: প্রভাষ আমিন,হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর