'এটা তোদের দেশ নয়, নিজের দেশে ফিরে যা!'

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 02:49:46

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে তথাকথিত উন্নত, গণতান্ত্রিক, মানবিক দেশে শোনা যাচ্ছে বর্বরোচিত হুঙ্কার। সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠ থেকে অভিবাসী, সংখ্যালঘু, ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে প্রান্তিক মানুষের প্রতি উচ্চারিত হচ্ছে ঘৃণা ও হুমকি। তীব্র শ্লেষাত্মক ভাষায় ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলা হচ্ছে 'এটা তোদের দেশ নয়, নিজের দেশে ফিরে যা!'

আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসদেশের নগররাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল এমন বর্বরতা। বিদেশিদের দেওয়া হতো না নাগরিকত্ব। তারা ছিল অধিকার ও আইনের প্রশ্নে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির। পুরো জীবন কাটালেও তারা ছিল 'বিদেশি', 'নাগরিক' নয়।

এখন, কোনো কোনো দেশে মূল ভূখণ্ডের বাইরে থেকে আসা বিদেশিরা আইনগত নাগরিকত্বের সুযোগ পেলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে রয়েছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে। প্রায়শই তাদের নিগৃহীত হতে হয়। আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত হয়ে প্রাণ হারাতে হয়।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১-এর মার্চের মধ্যে আমেরিকায়  এশীয় ব‌শোদ্ভূত মানুষদের উপরে ‘ব্যক্তিগত হামলার’ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে একটাই বাক্য ছিল আক্রমণকারীদের মুখে— ‘গো ব্যাক টু ইওর কান্ট্রি। নিজেদের দেশে ফিরে যাও।’

সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান আমেরিকান স্টাডিজের এক অধ্যাপকের স্ত্রী বাড়ির সামনে হাঁটছিলেন। একজন এসে তার মুখে থুতু ছিটিয়ে চিৎকার করে বলে, 'তোমরাই এখানে ভাইরাস নিয়ে এসেছ। তোমাদের ভাইরাস ফেরত দিয়ে দিলাম!’

লসঅ্যাঞ্জেলেস, ওকল্যান্ড, সানফ্রান্সিসকো অথবা নিউইয়র্কের চায়না টাউনে থাকা বহু মানুষ তাদের বয়স্ক মা-বাবাদের বাড়ির বাইরে একা পাঠানো বিপজ্জনক মনে করছেন। ‘সেভ আওয়ার এল্ডারস’ বলে একটি আন্দোলনও শুরু করেছেন তারা। বিলাতে আক্রমণের শিকার হয়ে বহু এশীয় প্রাণ হারিয়েছেন। এমন নৃশংসতার আখ্যান নিয়ে সরেজমিন অভিজ্ঞতায় 'বর্ণ সন্তান' নামে উপন্যাস রচনা করেছেন কথাশিল্পী মহীবুল আজিজ।

সমস্যাটি এখন জটিল ও প্রবল আকার ধারণ করেছে আমেরিকায়। এশিয়ানদের মধ্যে আমেরিকায় প্রথম প্রজন্ম নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় বহু প্রজন্মের চীনা বংশোদ্ভূত মানুষ বাস করেন, যাদের দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খুব ক্ষীণ। যাদের আক্রমণ করা হচ্ছে, তারা বেশির ভাগ মহিলা বা বয়স্ক। অনেকে আদপেই চীনা নন, তাদের আদি বাড়ি ফিলিপিন্স, কোরিয়া বা ভিয়েতনাম তথা দূরপ্রাচ্য বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। অথচ চীনাদের বিরুদ্ধে উগড়ে দেওয়া পুরোটা ঘৃণা হজম করতে হচ্ছে 'চীনাদের মতো দেখতে' মানুষগুলোকে। যেমনভাবে মুসলিমদের হনন করতে গিয়ে দাড়িগোঁফ আর পাগড়িওয়ালা শিখদেরও প্রাণ হারাতে হয় আমেরিকায়, কানাডায়, ইউরোপে।

ঘৃণা, বিশেষত জাতিগত ঘৃণা আসলেই এতোটা তীব্র যে ন্যায়বোধ মানে না। নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে রক্তে হাত ভাসায়। হিটলার বা আধুনিক কেউ এহেন ঘৃণার কারণে একাকার ও অভিন্ন।সংখ্যালঘুদের প্রতি এই ঘৃণা পৃথিবীতে বা আমেরিকায় নতুন নয়। ৯/১১-র পরেও শিখ আর তালিবানের পাগড়ির পার্থক্য করেনি বর্ণবিদ্বেষীরা। একটাই যা আশার কথা। নতুনল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ বিষয়ে যথেষ্ট কড়া অবস্থান নিয়েছেন। সম্প্রতি ‘এশিয়ান কমিউনিটি’র উপরে হিংসার তীব্র প্রতিবাদ করে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, বর্তমান নেতৃত্ব কোনো ধরনের বর্ণবাদকে বরদাস্ত করবে না।

আমেরিকার সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার ‘চীনা ভাইরাস’ বলে যে বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন, তার আঁচ নেভানোর সময়ে এসে গিয়েছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর পরে এখন নতুন করে লড়াই শুরু করতে হচ্ছে বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধেও। বিশেষত, জাতি বা ধর্ম বা সংস্কৃতিগত বিদ্বেষের দ্বারা হিংসার আগুন মানুষকে দগ্ধ করছে তথাকথিত আধুনিককালেও। এর সাথে জড়িয়ে আছে জেনোফোবিয়া নামের একটি শব্দ।

জেনোফোবিয়া গ্রিক ভাষার শব্দ। । অপরিচিত বা নিজেদের মতো হয়, এমন মানুষের প্রতি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা বা বৈরিতা প্রকাশ করে এ শব্দ, যা জাতীয়, ধর্মীয় বা সামাজিক বিভাগের ভিত্তিতে বৈরিতা সৃষ্টি করতে পারে। এটি আক্ষরিক অর্থেই 'dislike of or prejudice against people from other countries.'

এমন জেনোফোবিয়া প্রাচীন বা মধ্যযুগে চলেছে প্রবল গতিতে, যা আবার দেখা যাচ্ছে উত্তর-আধুনিক জীবনে অতি উন্নত, অগ্রসর ও মানবিক ইউরোপ-আমেরিকায়। প্রায়শই মিডিয়ায় আসছে বহু ন্যাক্কারজনক ঘটনা। দিন কয়েক আগে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে দিনের আলোয় বছর পঁয়ষট্টির এক ফিলিপিনো মহিলাকে অশালীন গালিগালাজ ও প্রবল শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হল। আঘাতের তীব্রতায় তিনি মাটিতে পড়ে যান। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছে, পড়ে যাওয়ার পরেও আক্রমণকারী তার পেটে লাথি মেরে চলেছে। আর গালি দিতে দিতে একটাই কথা বলে যাচ্ছে সেই শ্বেতাঙ্গ, ‘এটা তোদের দেশ নয়, নিজের দেশে ফিরে যা!’

ভিডিয়ো ফুটেজেই দেখা গিয়েছে, সেখানে তখন অন্তত তিন জন প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন আবার সামনের বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী। কিন্তু দুঃখের কথা, কেউই সেই মহিলাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছেন না। বেশ কিছুক্ষণ এ রকম চলার পরে মহিলার মাথায় লাথি মেরে চলে যায় লোকটি।

গত কয়েক মাসে এমন অসংখ্য এশীয়-নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে আমেরিকা জুড়ে। ষেমন গত মাসেই আটলান্টার স্পা-তে এশীয় মহিলাদের গুলি করে হত্যার ঘটনা। সানফ্রান্সিসকোয় শারীরিক নিগ্রহের জেরে মারা গিয়েছেন চুরাশি বছর বয়সের এক চীনা বৃদ্ধ। আরো একাধিক মৃত্যুর খবর এসেছে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। লসঅ্যাঞ্জেলেস, ও সানফ্রান্সিসকো— দু’শহরেরই চার পাশের এলাকায় এমন একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। নিউইয়র্কের

ম্যানহাটনের এক বিখ্যাত চীনা রেস্তরাঁর দু’জন কর্মচারীর উপরে আক্রমণের পরে এখন দোকানের মালিক রাত আটটায় রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিচ্ছেন। তার মনে হচ্ছে, নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট বা যানবাহন এশীয় বংশোদ্ভূত বা আরো ব্যাখ্যা করে বললে ‘চীনাদের মতো দেখতে যারা’, তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়।

মানুষের নিরাপত্তার কাঠামো তছনছ করা হলে গণতন্ত্রের সৌধ ভেঙে পড়বে। মানবিকতা ও মানবাধিকারের মিনার ভূপতিত হবে। মনুষ্যত্বের মৃত্যু হবে। বেঁচে থাকবে আদিম হিংস্র বর্বরতা, যা পৃথিবী, মানুষ ও সভ্যতার জন্য মোটেই কাম্য নয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর