নিজের অজান্তেই ফেসবুকে ঘৃণা ছড়াচ্ছি!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 08:57:22

সম্প্রতি একজন নারী, একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গাড়ি পার্কিংয়ের ঘটনায় অকথ্য ভাষায় কটাক্ষ করে অপরাধ করেছেন। সেটা অবশ্যই বড় অপরাধ। কিন্তু ওই পুলিশ কর্মকর্তা সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে কী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন? অপরাধের জন্য তার আইনানুগ সাজা হওয়া উচিৎ। কিন্তু তাকে সামাজিকভাবে হেয় করে সারা জীবনের জন্য কলঙ্ক লেপে দেয়ার আগে কী ভাবছি, কেন এমন করছি? আমরা যারা সেই নারীকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে নিজেদের ভেতরের নোংরামি প্রকাশ করে পোস্ট করেছি, তারা কী দ্বায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছি? সেই নারীতো এমন কোনো অপরাধ করেননি, যার কোনো প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে না। তবে সেই পথও কী আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি না?

এই তো সেদিনের ঘটনা। একটি টিভি চ্যানেলে সুন্দরী প্রতিযোগীতায় বিচারকদের প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারলেন না অংশগ্রহণকারীরা। হয়তো প্রশ্নগুলো অনেক সহজ ছিল, ইংরেজিটা একেবারেই প্রাইমারি লেভেলের ছিল। কিন্তু এমনতো হতে পারে যে তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় সহজ উত্তরগুলোও মনে আসছিল না। ভুলতো মানুষই করে। আর সেই মেয়েদের ভুলের ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে কী তাচ্ছিল্যটাই না করছি আমরা! যেন এমন ভুল করা মেয়ের বাঁচার অধিকার নেই! যেন এমন ভুল করা মেয়ের লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া উচিৎ।

এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠছে আমাদের অভিব্যক্তি প্রকাশের, ‍ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যম। মুহূর্তেই যেমন আমরা গুজব রটিয়ে দিচ্ছি, তেমনি সামাজিকভাবে কাউকে হেয় করতে ধারালো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি এই মাধ্যম। এর আগে আমরা যারা ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, মাস্টার্স পাশ, অনার্স পাশ কেউই ভাবছি না কীভাবে একটি জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি।

শুধু নারী বলেই কী এই বিষয়গুলো শেয়ার করে, ঘৃণা ছড়িয়ে, ধিক্কার দিয়ে আমরা পুরুষত্বের পরিচয় দিচ্ছি! নাহ, শুধু তা নয়। জাতীয় দলের ক্রিকেটার লিটন দাস এইতো সেদিন মরুর বুকে এশিয়া কাপের ফাইনালে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি হাঁকালেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই ক্রিকেটার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দেবী দুর্গার একটি ছবি দিয়ে পূজার শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। মূহূর্তেই হামলে পড়লাম আমরা তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা! তাকে হুমকি দিয়ে অশ্রাব্য, অশ্লীল আর কুরুচিপূর্ণ গালির স্রোত বইয়ে দিলাম! শেষমেশ ভয়ে বেচারা ছবিটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এতে কী আমাদের জয় হল?

নিজ নিজ ধর্ম পালন করা, ধর্মীয় উৎসব করার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান। মুসলমানরা ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে পারলে হিন্দু লিটনও অধিকার রাখেন পূজার শুভেচ্ছা জানানোর। তার জন্য তাকে কেন জীবনের হুমকিসহ অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে হবে?

আমরা কী জানি লিটন দাসকে কতটুকু কষ্ট দিলাম! কতটুকু অভিশপ্ত করে তুলেছি সেই গাড়িতে বসে হুমকি দেয়া নারী বা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় ভুল করা তরুণীদের জীবন!

নাহ ফেসবুক বা টুইটার বা ইউটিউব আমার বা আপনার ব্যক্তিগত আর নেই। এটা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে রূপ নিয়েছে, সেখানে আচরণটাও সামাজিক হতে হয়। যেমন চাইলেই আমরা রাস্তায় কাপড় ছাড়া হাঁটতে পারব না, তেমনি ফেসবুকেও যা ইচ্ছে তা বলার সুযোগ নেই। আমাদেরকে আরও ভাবতে হবে, নিজেদের দেয়া পোস্টের কারণে কোনো জীবনকে অভিশপ্ত করে তুলছি কিনা আমরা।

আমরা যে বাক স্বাধীনতার কথা বলছি, মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলছি, সেটা কিন্তু কাউকে আঘাত করে নয়। সেটা কিন্তু আরেকজনের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে নয়। মত প্রকাশ আর ঘৃণা ছড়ানো কিন্তু এক কথা নয়। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাতের কিছু সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনে আমি নিয়মিত চোখ বুলাই। সেখানে চুরির অপরাধে জড়িত ব্যক্তি আটক হলে তার নাম প্রকাশ করা হয়। এমনকি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অপরাধে আটক ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয় না। তবে তা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রকাশ করা হয় না। তাও খুব সতর্কতা অবলম্বন করে।

এশিয়ান জার্নালিজম ফেলোশিপে অংশগ্রহণের সময় সিঙ্গাপুর অবস্থানকালে নানিয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক টেন্ডর জুনিয়রকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন আপনারা এই নামগুলো প্রকাশ করেন না? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তাদের যে অপরাধ সেটা শুধরানোর সুযোগ রয়েছে। তবে গণমাধ্যমে যদি আমরা সেই নাম এবং পরিচয় তুলে ধরি তাহলে তার পরিবার যেমন সামাজিকভাবে অপমানিত হবে, তেমনি তার ভবিষ্যতে ভালো হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই মানুষকে সঠিক পথে ফেরার পথ যেন বন্ধ না হয়ে যায়, সেই দিকটি আমাদেরকেই দেখতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর