করোনা মহামারিকালীন বাংলাদেশে এনজিও-এমএফআই’র ভূমিকা

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান ও শিশির রেজা | 2023-09-01 16:35:25

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেছে। এনজিওগুলো শুরুতে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের পূর্নবাসন ও জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করার জন্য ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। বাংলাদেশ অনেক ভাল কাজের মধ্যে এনজিও কার্যক্রমের জন্যও আজ বিশ্বে পরিচিত।

বাংলাদেশের এনজিওগুলো তাদের উজ্জ্বল ও দৃষ্টান্তমূলক কর্মকা-ের দ্বারা দীর্ঘসময় অতিক্রম করে এসেছে। এই দীর্ঘসময়ে তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগণের দ্বারে গিয়ে পৌঁছেছে। এনজিওগুলো বিভিন্ন সময়ে তাদের বহুমুখী সেবার মাধ্যমে জনসাধারনের বিশেষ করে দরিদ্র জনসাধারনের স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসগৃহ নির্মাণ, প্রাক-বিদ্যালয়, আয়-বর্ধণমূলক কর্মকা-ের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রদান এবং সর্বোপরি বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করার জন্য তাদেরকে দলবদ্ধ করে তোলে। এনজিওগুলোর কার্যক্রম ও অবদানের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সূচক, স্বাস্থ্য সূচক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সারা বিশে^ প্রশংসনীয় হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতি ও সমর্থন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বর্তমানে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো বহুমুখী সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এইসব এনজিওর মধ্যে অনেক এনজিও বিগত কয়েক দশক যাবত অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋন বা ক্ষুদ্রঅর্থায়ন কার্যক্রমও পরিচালনা করে আসছে যারা বেসরকারি সংস্থা-ক্ষুদ্র অর্থায়ন ইনস্টিটিউট (এনজিও-এমএফআই) হিসেবে পরিচিত। এসব সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নিবন্ধনপ্রাপ্ত এবং এমআরএ-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর অবধি ৭৪৬ টি এনজিও-এমএফআই এমআরএ-এর নিবন্ধন নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মোট অর্থের স্থিতির পরিমাণ এবং সুবিধাভোগী বা সদস্য সংখ্যা বিবেচনা করে এসব এনজিও-এমএফআইগুলোকে বড়, মাঝারি এবং ছোট এই তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মত বৃহৎ এনজিও-এমএফআই রয়েছে। তবে বেশিরভাগই মধ্যম ও ছোট এনজিও-এমএফআই।

এনজিও-এমএফআইগুলো তাদের ক্ষুদ্রঋণ বা ক্ষুদ্রঅর্থায়ন কর্মসূচি এবং অন্যান্য পরিষেবা গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্র লোকদের মধ্যে পরিচালনা করে যারা প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (গ্রামীণব্যাংক ব্যাতীত অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য বিবেচিত হয়না। এনজিও-এমএফআই-এর বেশিরভাগ সুবিধাভোগী হলেন গ্রাম ও শহরের দরিদ্র নারী, পুরুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভ্রাম্যমান পণ্য বিক্রেতা, রিকশা-ভ্যান চালক, মুদি দোকানদার ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেকে তাদের বিনিয়োগের অর্থের উৎস হিসেবে ক্ষুদ্র্ঋণ বা ক্ষুদ্রঅর্থায়নকারি সংস্থাগুলোর উপর নির্ভর করে থাকে। তাদের আয়বর্ধণমূলক কার্যক্রম (আইজিএ), ছোট ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহ করতে এইসব প্রতিষ্ঠানের উপর বেশিমাত্রায় নির্ভর করেন যেহেতু তারা আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনও আর্থিক সহায়তা পান না। এনজিও-এমএফআইগুলো তাদের আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তি বা ঋণগ্রহণের একমাত্র উৎস। তাদের বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন যা বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশ। একথাও বলা হয় যে, ক্ষুদ্র্ঋণ বা ক্ষুদ্রঅর্থায়ন কার্যক্রম হলো বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির জীবন সঞ্জীবনি বা চালিকাশক্তি।

করোনা মহামারিকালীন ওইসব এনজিও-এমএফআইগুলোর পরিস্থিতি বা তাদের ভূমিকা ও কার্যক্রম জানতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত কয়েকটি নির্বাচিত ছোট এনজিও-এমএফআই-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে ফোনে একটি দ্রুত সমীক্ষা (সাক্ষাৎকার) নেয়া হয়। এ সাক্ষাৎকার বা সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে এইসব ছোট এনজিও-এমএফআই তাদের সবচেয়ে দূর্বল সদস্য বা সুবিধাভোগীদের এককালীন খাদ্য সহায়তা প্যাকেজ যেমন চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, লবণ ইত্যাদি সরবরাহ করে ক্ষুধা বা অনাহার থেকে তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে এবং এখনও অনেক সংস্থা এ ধারা অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে গত বছরের (২০২০) দীর্ঘ লকডাউন সময়কালে তারা এটি বেশি করেছে।

খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি এইসব সংস্থা করোনা ভাইরাস থেকে তাদের সদস্য বা ঋণগ্রহীতাদের রক্ষা করার জন্য সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মাস্ক সরবরাহ করেছে। সর্বোপরি, সরকারি নিদের্শনা মোতাবেক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে,স্বাস্থ্যকর আচরণ অনুশীলণ করে কীভাবে নিজেদেরকে, পরিবারের সদস্য এবং সমাজের অন্যান্য লোকদের করোনা আক্রান্ত  থেকে রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কে সুবিধাভোগীদের সচেতন করেছেন এবং এখনও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

জরিপকৃত ছোট এনজিও-এমএফআই তাদের কর্মীদের (ক্রেডিট অফিসার, ক্রেডিট সুপারভাইজার এবং অফিসের অন্যান্য কর্মীদের) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য ফেসমাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভস এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করেছে কারণ তারা ফ্রন্টলাইন কর্মী। এই কর্মীরা গ্রাম ও শহরাঞ্চলে দরিদ্র নারী এবং পুরুষ সুবিধাভোগীদের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। সাধারণত, জনাকীর্ণ জায়গায় তাদের কাজ করতে হয় এই জন্য তাদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

ছোট এনজিও-এমএফআইগুলোর মতো মাঝারি ও বড় এনজিও-এমএফআইগুলোও এই মহামারি পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা তাদের সদস্যদের বা ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষার জন্য খাদ্য সহায়তা, আর্থিক সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। কর্মীরা নির্ভরযোগ্য, জীবনরক্ষামূলক তথ্য সরবরাহ করে তাদের সুবিধাভোগীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোও ব্যবহার করছে।

এইসব সংস্থা এমআরএ জারীকৃত নির্দেশনা অনুসরণ করে লকডাউন চলাকালীন ঋণের কিস্তি সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঋণের শ্রেণিকরণ করাও বন্ধ রেখেছিলেন। ঋণগ্রহীতারা তাদের সুবিধাজনক সময়ে যাতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন সে সুবিধাও তারা প্রদান করেছে। অনেক ঋণগ্রহীতা এই করোনাকালীন তাদের জমাকৃত সঞ্চয় উত্তোলন করে নিয়েছেন। যার ফলে, ছোট এনজিও-এমএফআইগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় বজায় রাখতে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে ও হচ্ছে। বিশেষ করে অফিস ব্যয় পরিচালনা ও কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদানে আর্থিক সংকটে ভুগছে।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এনজিও-এমএফআইগুলোর জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বরাদ্দ করেছে তবে অনেক ছোট এনজিও-এমএফআই তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রণোদনা প্যাকেজটি থেকে কোনো অর্থ নিতে পারেননি। বর্তমান লকডাউন সময়কালেও তারা আবার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।

এইসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এনজিও-এমএফআইগুলো মহামারি চলাকালীন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র সুবিধাভোগীদের আর্থিকভাবে সুরক্ষা দিচ্ছে, তাদের জন্য খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা করছে। সর্বোপরি, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য তাদের সুবিধাভোগী ও কর্মীদের অবিরামভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এনজিও-এমএফআই সেক্টরের হাজার হাজার কর্মী তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন।

এ কথা সত্য যে, সরকার এককভাবে সবকিছু করতে পারে না। সুতরাং এনজিও-এমএফআইগুলোর মতো দেশের অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারও উচিত মহামারিকালীন অসংখ্য দরিদ্র মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে আরো বেশি মাত্রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

ড. মতিউর রহমান, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা এবং শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

এ সম্পর্কিত আরও খবর