কোভিড-১৯, স্মৃতিভ্রংশ, অনিদ্রা

, যুক্তিতর্ক

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 15:45:31

প্রথমে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকেরই মস্তিষ্কে হ্যামারেজ হয়েছে। কোভিড থেকে ভালো হয়েও  মৃত্যু হয়েছে অনেকের। গত এক বছর চার মাসে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়ে মিলেছে এমন উদাহরণ।

ফলে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, তবে কি করোনাভাইরাস সরাসরি সংক্রমিত হয় মস্তিষ্কেও? চিকিৎসকদের একাংশের আশঙ্কা ছিল এমনই। এবার আশ্বস্ত করলেন গবেষকরাও।

সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাল, সরাসরি মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করতে পারে না সার্স-কোভ-২। তবে পরোক্ষভাবে স্নায়বিক ক্ষতি করে ভাইরাসটি। মস্তিষ্কে যার প্রভাব কখনও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি বিপদের কারণ।

যদিও এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল, ভাইরাসের অজানা চরিত্রের বিষয়ে আলোকপাত করা। তা সত্ত্বেও মস্তিষ্কের ওপরে ভাইরাসের প্রভাবের ওপরেই বেশি করে জোর দিয়েছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেই চলেছিল অনুসন্ধান। তবে প্রধান গবেষক জেমস ই গোল্ডম্যানের দাবি, মস্তিষ্কের কোষে কোনোভাবেই ভাইরাল আরএনএ বা প্রোটিনের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তাঁরা।

সব মিলিয়ে ৪১ জন কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির ওপরে এই গবেষণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সকলেই প্রাপ্ত বয়স্ক। বয়স ৩৮ থেকে ৯৭ বছর। প্রাথমিকভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল তাঁদের ক্লিনিকাল রিপোর্ট। সেখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল করোনাভাইরাসে প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে প্রত্যেকের ফুসফুস। তবে প্রত্যক্ষভাবে কোনো প্রভাব নেই মস্তিষ্কে। পরবর্তীতে তাঁদের মস্তিষ্কের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান করান চিকিৎসকরা। তাতেও আশানুরূপ ফলাফল আসে।

তবে এখানেই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছিল না সত্যিই আক্রান্ত কিনা মস্তিষ্ক। ফলত মস্তিষ্কের নিউরোন ও গ্লিয়া কোষগুলোর মধ্যে ভাইরাল আরএনএ-র শনাক্তকরণের জন্য সিটু ও আরটি-পিসিআর টেস্ট করা হয়। কারণ ভাইরাস দ্বারা মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে, ভাইরাল প্রোটিন ও আরএনএ-এর ছাপ থেকে যায় কোষগুলোতে।

কিন্তু সেই পরীক্ষাতেও তেমন কোনো প্রমাণ পাননি গবেষকরা। যদিও আরটিপিসিআর টেস্টে মস্তিষ্কের আচ্ছাদনকারী লেপটোমিনেজ স্তরে অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ ভাইরাল আরএনএ-এর অস্তিত্ব দেখা গেছে। গবেষকদের অনুমান, এই অংশটির সঙ্গে রক্তনালির যোগ থাকায়, রক্তবাহিত হয়েই সেখানে পৌঁছেছে ভাইরাসের আরএনএ। তা মস্তিষ্ক সংক্রমণের সূচক হতে পারে, কিংবা  না-ও পারে।

তবে, করোনার প্রসঙ্গ ছাড়াও একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলা যেন আজকের সময়ের দস্তুর। ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগের নাম ডিমেনশিয়া। তবে কীভাবে এই রোগ মানুষের মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে, তার সঠিক ধারণা আজও চিকিৎসকদের কাছে নেই। নিদ্রাল্পতার সঙ্গে এই রোগের সম্পর্কের কথা আলোচিত হলেও সেই সম্পর্ক ঠিক কেমন, তা জানা ছিল না। সম্প্রতি এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন জার্মানির একদল স্নায়ুবিজ্ঞানি। নেচার কমিউনিকেশন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানিরা জানিয়েছেন, ৫০-৬০ বছর বয়সে যেসমস্ত মানুষের ঘুমের সময় কমে যায়, ৭০ বছরের মধ্যেই তাঁদের ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

বার্লিন শহরের ৮ হাজার মানুষকে ২৫ বছর ধরে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখে অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণার লক্ষই ছিল নিদ্রাল্পতার সঙ্গে ডিমেনশিয়ার সম্পর্ক স্থাপন করা। এই ২৫ বছর ধরে প্রত্যেকের ঘুমের সময়ের হিসাব রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসমস্ত মানুষ দিনে ৭ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেশ কম। অন্যদিকে যাঁরা ৫০-৬০ বছর বয়স থেকেই তার থেকে কম সময় ঘুমান, তাঁদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি।

ডিমেনশিয়া রোগীদের মধ্যে অনিদ্রার প্রবণতা অনেক সময়েই দেখা যায়। তবে এই ঘটনাকে ডিমেনশিয়ারই একটি উপসর্গ হিসাবে মনে করতেন অনেকে। সেই সম্ভাবনাও অবশ্য একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্নায়ুবিজ্ঞানিললরা। কিন্তু স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার অন্তত ২০ বছর আগে তার উপসর্গ দেখা দেওয়া অনেকটাই অসম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা। অতএব এটি নিছক উপসর্গ নয়, রোগের কারণও বটে। এর মধ্যে সারা পৃথিবীজুড়েই কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে ঘুমের সময় কমে আসছে। এখন এই প্রবণতা যদি ডিমেনশিয়ার মতো রোগের কারণ হয়, তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ অনেকটাই বেশি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানিরা।

কিন্তু মস্তিষ্ক আক্রান্ত না হলেও, করোনাভাইরাস রক্তপ্রবাহ এবং দেহের অন্যত্র স্নায়ুতন্ত্রে যে পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কোভিড রোগের বা মহামারির টেনশনে দুশ্চিন্তা এবং ঘুমের ঘাটতিও আক্রান্ত করতে পারে মস্তিষ্ককে। ফলে চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে কোভিড-১৯, স্মৃতিভ্রংশ, অনিদ্রা মতো বিষয়গুলো গবেষকদের সামনে ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর