করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, ঈদযাত্রা ও প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান ও শিশির রেজা | 2023-08-30 07:24:40

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার এই ধরন আমাদের জন্য অতিমাত্রায় বিপদজনক। এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমেও মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম। ভারতে এই ভাইরাসের ভয়াবহতা আমরা বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবত প্রত্যক্ষ করছি; যেখানে সরকারি হিসেবে প্রতিদিন চার লক্ষেরও অধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং চার হাজারের অধিক মানুষ মারা যাচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের শোচনীয় অবস্থা ও তাদের স্বজনদের আহাজারি আমরা গণমাধ্যমে প্রতিদিন দেখছি। হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট, চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দিবারাত্র ধরে অবিরাম সেবাদান উদ্ভূত ক্লান্তি, শ্মশানে লাশের দীর্ঘ সারি, লাশ দাহ কার্যে নিয়োজিত কর্মীদের সংকটাপন্ন অবস্থা এসব কিছুই আমরা পড়ছি ও দেখছি সংবাদপত্রে এবং দেশি-বিদেশি টেলিভিশনের পর্দায়। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গণমাধ্যমে ভারতের করোনা পরিস্থিতির যে অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি বাস্তবে অবস্থা তারচেয়েও ভয়াবহ।

বাংলাদেশে পবিত্র রমজান শেষে এ মাসের তেরো বা চৌদ্দ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসব। এই উৎসব পালন করতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাশহর থেকে মানুষ ছুটছে গ্রামের দিকে। কিন্তু কিভাবে তারা গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে তা আমরা ইতিমধ্যে সংবাদপত্র পড়ে ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় এ বছরের মার্চ মাস থেকে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে এবং আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর থেকে রোগী শনাক্তের হার কমতে শুরু করে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সংক্রমণ কিছুটা বাড়লেও তারপর থেকে সংক্রমণ নিম্নগামীই ছিল। কিন্তু চলতি বছরের (২০২১) মার্চ মাস থেকে ফের আছড়ে পড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ অনেক বেশি তীব্র আকার ধারণ করে। মার্চ থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও ফের বাড়তে শুরু করে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। প্রতিদিন শনাক্ত ও মৃত্যুহার রের্কড ভাঙে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ থেকে সরকার বেশ কিছু বিধিনিষেধসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে। এর মধ্যে ঘরের বাইরে গেলে মাস্কের ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি অন্যতম।

সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়তে থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতা রয়েই যায়। এমতাবস্থায়, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে প্রথম দফায় সাত দিনের ‘লকডাউন’ শুরু হয়ে চলে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় কঠোর লকডাউন দেয় সরকার। এরপর গত ২২ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত আরও এক সপ্তাহ লকডাউন বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না থাকায় ১৬ মে পর্যন্ত চলমান লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সরকার ঘোষণা দেয় লকডাউনের মধ্যে দূরপাল্লার পরিবহন, ট্রেন ও লঞ্চ আগের মতই বন্ধ থাকবে। তবে ৬ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জেলার মধ্যে গণপরিবহন চলবে।

বাংলাদেশে ১৩ মে থেকে তিন দিনের ঈদের ছুটি শুরু হবে। ঈদে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বিগত কয়েকদিন ধরে হাজার হাজার মানুষ মাওয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে হাজির হচ্ছে। তারা ঢাকা থেকে বিভিন্ন ছোট ও ব্যক্তিগত পরিবহনে ও পায়ে হেঁটে ফেরিঘাটে হাজির হচ্ছেন। তাদের চাপে মাওয়া ও পাটুরিয়ার ফেরি চালু হয়। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার কাজে নিয়োজিত পরিবহনের সাথেই তারা ফেরি পার হচ্ছে।

বিগত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাটুরিয়া ও মাওয়া ঘাটে যেভাবে হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে ফেরি পার হয়েছে ও হচ্ছে তাতে করে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এর মাধ্যমে তৃতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশ যে পার্শ্ববর্তী ভারতের মত হবে না একথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারে না। যারা ফেরি পার হচ্ছেন ও গাদাগাদি করে যাতায়াত করছেন তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানা তো দূরে থাক তাদের অনেকেই করোনাকে অনেকটা অবজ্ঞাই করছেন। অনেকে মন্তব্য করেছেন মৃত্যু তো হবেই করোনায় মরলে সমস্যা কী? অনেকে বলেছেন, ঘর থেকে দোয়া-দরূদ পড়ে বের হয়েছি- করোনা আমার কিছু করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেছেন, এই করোনা আর কখনও বিদায় হবে না, কাজেই এইভাবেই আমাদের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ করতে যেতে হবে। সরকার মাঝখান থেকে গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ রেখে আমাদেরকে বিপদে ফেলেছে। অনেকেই বলেছেন, ঢাকা শহরে কাজ নাই-গ্রামে না ফিরে উপায় কী? অনেকেই বলেছেন, করোনা হোক আর যাই হোক ঢাকায় থাকার উপায় নেই। ঢাকায় থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।

তবে সবাই যে এই পরিস্থিতিতে ঢাকা ছাড়ছেন তাও নয়। অনেকই ব্যক্তিগত গাড়ি বা ২৫-৩০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে মাইক্রোবাসে ঢাকা ছাড়ছেন। তারা আসলে গ্রামে সবার সাথে ঈদ করতে যাচ্ছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গ্রামে সবার সাথে ঈদ করতে চাই। ঢাকায় ঈদে তো ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু এই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও এত বিপুল মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য জবরদস্তি করা সম্ভব নয়।

এ পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র ঈদুল ফিতর নিজ নিজ অবস্থানে থেকেই উদযাপন করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভ্রমণ করোনাভাইরাসের বিস্তার আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রটোকলগুলো বজায় রাখতে এবং অত্যন্ত জরুরি না হলে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে আপনাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ রইল।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘জীবন সবার আগে। বেঁচে থাকলে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঈদ উপলক্ষে সবাই ছোটাছুটি না করে যে যেখানে আছেন, সেভাবেই ঈদটা উদযাপন করেন। আর যাঁরা বিত্তশালী আছেন, যদি দুস্থদের একটু সহযোগিতা করেন, সেটা আরও বেশি সওয়াবের কাজ হবে বলে আমি মনে করি।’

করোনা যাতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সে জন্য সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি উল্লেখ করেছেন ‘কে যে সংক্রমিত সেটা আপনি জানেন না। কাজেই এই যাতায়াতটা করতে গেলেই সে যখন অন্য জায়গায় যাবে, তখন আরও অনেক লোককে করোনা সংক্রমিত করবে এবং তাদের জীবন নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করবে। সে জন্যই সরকার যাতায়াত সীমিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে।’

একথা সত্য, যেসকল মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই ঢাকা শহরের ভাসমান মানুষ। যাদের অনেকেই ছোট চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে যুক্ত। অনেকেই রিকশা-ভ্যান চালক কিংবা নির্মাণ কাজের শ্রমিক। অনেকেই ভ্রাম্যমাণ পণ্য বিক্রেতা। অনেকেই করোনাকালে কাজ হারিয়েছেন। কাজেই তাদের পক্ষে ঢাকা কিংবা অন্যকোন বড় শহরে বাসা ভাড়া করে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তুু তারপরও আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনটা আগে। জীবিকা পরে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই করোনাকালে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের জন্য আর্থিক প্রণোদনা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। মানুষ কর্মহীন হয়েছে, আয় কমে গেছে, দরিদ্রতা বেড়েছে এসবই সত্য কিন্তু করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কেউ না খেয়ে মারা গেছে একথা এখনও পর্যন্ত শোনা যায়নি।

কাজেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শুধু প্রিয়জনের সাথে ঈদ উৎসবের আনন্দ করতে ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি করে ঈদ যাত্রা করে কেউ যদি আমরা করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত হই তাহলে শুধু আমার নিজের জীবনই যাবে না, সেই সাথে হারাতে পারি আমাদের প্রিয়জনকেও। বিপন্ন করে তুলতে পারি পুরো সমাজের মানুষের জীবনকে। সেইসাথে সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতি। হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই করোনাকালীন সময়ে অক্লান্তভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্যও সেই পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। এই করোনাকালে নিজ সচেতনতা বা ব্যবস্থাপনা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ও শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

এ সম্পর্কিত আরও খবর