লকডাউনের কলকাতায়

, যুক্তিতর্ক

সুমন ভট্টাচার্য | 2023-08-29 21:36:11

'এক অকেলি ছত্রি মে যব যব আধে আধে ভিগ রহে থে
আধে সুখে, আধে গিলে, সুখা তো ম্যায় লে আই থি
গিলা মন শায়েদ বিস্তার কে পাস পড়া হো...'

লকডাউনের কলকাতায় বৃষ্টিতে ভিজে ফিরতে ফিরতে আমার আবার গুলজারের লেখা এই গানটার কথা মনে পড়ে গেল। উত্তর কলকাতার ঐতিহাসিক কলেজ স্ট্রিট পেরোনোর সময় নিঝুম রাস্তা আর আলোকোজ্বল-শতবর্ষী প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়) দেখে আমার সত্যিই এক ছাতার তলায় বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে নিয়ে ফেরা বিকেলগুলোর স্মৃতি টাটকা হয়ে উঠল। ডানদিকে তাকিয়ে একবার কফি হাউসের নীচটা দেখলাম, ওখানে কি এখনও কেউ শামীমের জন্য দাঁড়িয়ে আছে?
তারপর মনে হল সেটা তো গৌরকিশোর ঘোষের 'প্রতিবেশী' উপন্যাসে ছিল, এই লকডাউনের শহরে কে আসবে বন্ধ কফিহাউস খুলতে? করোনা অতিমারির এই পৃথিবীতে ইনফিউশন আর কবিতাকে সঙ্গী করে কতজন স্বপ্ন দেখছে?

যে রাস্তায় আগে এক সিগারেট দূরত্বেও মানুষ গিজগিজ করত, সেই সব রাস্তা এখন শুনশান। মহাত্মা গান্ধী রোডের কাছে গিয়ে অবশ্য বেশ কয়েকজনের দেখা পেলাম। বাইক থামিয়ে এরা সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় খুঁজছে। একটা গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে সবাই স্মার্ট ফোনে ঘাঁটাঘাটি করছে| প্রায় সকলের পরনেই লাল টি শার্ট দেখে আমি যখন রেড ভলান্টিয়ার্সদের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে ভেবে উল্লসিত, তখনই দেখি সকলের জামায় একই লোগো। ওহ হরি, এরা আসলে তাহলে দেশের জনপ্রিয় ফুড অ্যাপের কর্মী? এই রাতে স্মার্টফোন চোখ রেখে অর্ডার দেখে কোন রেস্টুরেন্টে যাবে তাই ঠিক করছে? এদের জন্যই তো আমরা ঘরে বসে বিরিয়ানি থেকে পিৎজা, সব ডেলিভারি পেয়ে যাই।

স্বপ্নভঙ্গর বেদনা নিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড পেরিয়ে আবার থামলাম। কলেজ স্ট্রিট বাজারের ফলপট্টির সামনেও বিস্তর লোকের ভিড়। এরা সব বিভিন্ন ফল নিয়ে আসছে অন্য শহর থেকে। অতিমারির এই পৃথিবীতে সবকিছুর লকডাউন হতে পারে, কিন্তু খাবারের যোগান তো থামলে চলবে না! সাবঅল্টার্নদের নিত্যদিনের কিংবা রাতের এই বারোমাস্যাই তো টিঁকিয়ে রেখেছে শহরের জীবন এবং যাপনকে।

বইয়ের কলেজ স্ট্রিট থেকে বাজারের কলকাতাকে পাশ কাটিয়ে আমার ঘরে ফেরার উদ্যোগ। হিন্দু বস্তি পেরিয়ে মুসলিম পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে একই ধরনের ফিসফিসানি শোনা, কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে সেই নিয়ে টুকটাক আলোচনায় কান পাতা। এরা সব দিন আনি, দিন খাই গোত্রের মানুষ। আল্লাহ অথবা মা কালী কখন এদের আকুতি শুনবেন এবং করোনার হাত থেকে বাঁচাবেন, সেই চিন্তাই কুরে কুরে খাচ্ছে।

এই সব কিছুই পেরিয়ে একসময় আমি পৌছে যাই আমার গন্তব্যে। বিছানার পাশে যিনি আমার জন্য তাঁর অর্ধেক ভেজা মনকে রেখে দারুচিনির দ্বীপে চলে গেছেন, সেই ভেজা মনকে সঙ্গী করে অতিমারির দিনগুলোকে কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প করি। অদূরে বয়ে যায় চিরবহতা গঙ্গা আর কলকাতায় সদ্যই ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে সঞ্চারিত মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট-কাচারি।

আমি যখন ঘুমে, তখন সে রাতেই (১৭ মে) কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে কলকাতার তিনজন প্রাক্তনসহ চারজন প্রথম নাগরিক 'মেয়র'। হিংসার রাজনীতি ইতিহাসমণ্ডিত মহানগরী কলকাতাকে ঘুমুতে দেবে?

সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর