তোফাজ্জল ইসলামের কৃষির বরপুত্র হয়ে উঠা

, যুক্তিতর্ক

অপূর্ব ধ্রুবচারী | 2023-08-31 22:14:56

সভ্যতার ভীত রচনায় কৃষকরাই যে সবচেয়ে অগ্রসেনানি তা অতি সত্য হলেও কুলীন সমাজ সেই স্বীকৃতি দেয়নি কোন কালেই। এই রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে একথাও আজ সমানভাবে সত্য যে বাংলাদেশের অনগ্রসর জনপদের খাঁটি কৃষকের সন্তানরাও এখন উঠে এসেছেন নায়কের আসনে।

কৃষি বিজ্ঞানের উৎকর্ষে আমাদের চিরায়ত কৃষি আজ অনেকটাই বদলে গেছে। ফলন বেড়েছে বহুগুণে, এসেছে ফসল বৈচিত্র্য। কৃষিতে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব এই সাফল্যের কারিগর নিষ্ঠাবান কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষকরা। উল্লেখ্য যে, কৃষিতে এই বিপ্লব সাধনে বিজ্ঞানী ও কৃষকদের এই যুক্ত প্রচেষ্টায় গভীর সংযোগ হচ্ছে-দেশের সিংহভাগ কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষকেরই সন্তান। আজন্ম কৃষির সাহচর্যে বেড়ে উঠা সন্তানরাই যে কৃষির দরদ বুঝবেন এই তো স্বাভাবিক!

আমরা আজ জানাবার প্রয়াস পাবো তেমনি একজন কৃষি বিজ্ঞানীর আদ্যোপান্ত। আশৈশব কৃষি কাজে প্রত্যক্ষ শ্রম দেওয়া একজন প্রখর মেধাবী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিতে উচ্চ শিক্ষার পাঠ গ্রহণে ঈর্ষণীয় সাফল্যে যেমন হয়ে উঠেছিলেন কৃষকের বরপুত্র, তেমনি নিবেদিত গবেষক হিসেবে তিন দশকে তিনি কৃষিরও বরপুত্র হয়ে উঠেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক গ্রহণ

বলছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই)’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. এম তোফাজ্জল ইসলাম শাহীনের কথা। ১৯৬৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শশই গ্রামে জন্ম নেওয়া এই কৃতি বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুখ্যাতি লাভ করেছেন তাঁর সমস্যাভিত্তিক কৃষি গবেষণার জন্য। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো তোফাজ্জল ইসলাম সম্প্রতি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিঘাতে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুৎসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে প্রধান দুই খাদ্য শস্য গম ও ধানে ব্লাস্ট সংক্রমণরোধে ব্লাস্টের জীবনরহস্য উন্মোচন তাঁর উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

কেবল দেশের গবেষকদেরই নয়, বিশ্বের খ্যাতিমান সব বিজ্ঞানীদের জোটবদ্ধ করে অধ্যাপক তোফাজ্জল স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই ইতিহাস রচনা করেন। ফলে বিদেশ থেকে আনা খাদ্যশস্যে এই সংক্রমণের উপস্থিতি নিশ্চিত হতে যে ব্যয়বহুল পরীক্ষার বিষয় ছিল তোফাজ্জল ইসলামদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান তা সহজেই পরীক্ষণ পর্ব সুসম্পন্ন করতে সহযোগিতা করবে। এতে সময় সাশ্রয়ের সঙ্গে বিপুল ব্যয়ও হ্রাস করা যাবে।

জীবপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী তোফাজ্জল ইসলামের অসংখ্য উদ্ভাবনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উপকারি ব্যাকটেরিয়ার বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করে অপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করা। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে একাধারে রাসায়নিক কীটনাশক নির্ভরতা হ্রাস করে পরিবেশবান্ধব কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করবে এবং ব্যয় সাশ্রয় করে ফসলের উৎপাদনবৃদ্ধি একসঙ্গে করা যাবে; যা নতুন যুগের টেকসই কৃষি উৎপাদনের এক উৎকৃষ্ট মডেল।

কিন্তু আমরা আজ এখানে অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামের গবেষণা অর্জন নিয়েই কথা বলতে আসিনি। তাঁর আরেকটি যুগান্তকারী সাফল্যের চিত্র তুলে ধরতে এসেছি। অধ্যাপক ইসলাম বিশ্বের সমকালীন বিজ্ঞান গবেষণার প্রাগ্রসর একটি প্রচেষ্টার উল্লেখযোগ্য এক নাম, বাংলাদেশের উজ্জ্বল মুখ। অন্যদেশ বা প্রতিষ্ঠানের থেকে নিজেদের গবেষণা তথ্য-উপাত্ত আড়াল করে রেখে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সনাতনী-পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণাকে বিদায় জানিয়ে অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম ‘মুক্ত তথ্য বিনিময়’ এর মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে আরও বেশি উপকৃত করার একজন নিবেদিত গবেষক।

নিজগ্রামে সংবর্ধিত

এই গণমুখী প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে নিজের স্বকীয় অবস্থান মেলে ধরেছেন তিনি। তাঁর এই প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই সুফল এনে দিয়েছে আমাদের। দেশে-বিদেশে আমাদের অসংখ্য মেধাবী গবেষককে একসুঁতোয় গেথে তিনি পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার ঝুঁকি হ্রাসে অবদান রাখছেন, সেইসঙ্গে আমাদের তরুণ গবেষকদের মধ্যে একটি নতুন ধারণারও প্রসার ঘটিয়েছেন। স্মরণযোগ্য যে, তোফাজ্জল ইসলামের এই গবেষণা প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি গবেষকরাই নন, লন্ডনের রয়েল একাডেমির খ্যাতিমান দুই বিজ্ঞানীও অংশ নিয়ে উদার ও গণমূখি বিজ্ঞান গবেষণায় নিজেদের শামিল করেছেন। ড. সোপিয়েন কামায়্যুন এর মতো লন্ডনের রয়েল একাডেমির ফেলো অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের মেহেরপুরের প্রত্যন্ত জনপদে ব্লাস্ট সংক্রমিত গম ক্ষেতে কাজ করে গেছেন।

সম্প্রতি বশেমুরকৃবি আন্তর্জাতিক সিমাগো র‌্যাংকিংয়ে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জনের পেছনেও ছিলেন অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম। সিমাগো ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান সাময়িকীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের’ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যাঁর অধিকাংশের মুখ্য গবেষক ছিলেন অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম।

আমাদের বিজ্ঞান গবেষণায় এই অগ্রসরমান অবস্থা নিয়ে কোন স্তর থেকেই কাউকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি আমরা। অথচ তুচ্ছ রাজনৈতিক মন্তব্য নিয়ে আমরা দিনকে দিন তোলপাড় করি। কিন্তু সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় সঞ্জীবনী শক্তি যে বিজ্ঞান গবেষণা, তাকে আমরা ব্রাত্য করে রাখি কিংবা ‘যেনতেন’ একটি মূল্যায়নেই তুচ্ছ রাখি। অন্তত এই সত্য নিয়ে কারোর দ্বিমত করার সুযোগ নেই যে, বর্তমান বিশ্বের অতি উন্নত-সম্বৃদ্ধ দেশসমূহের প্রধান নিয়ামক তাদের উন্নত-বিকশিত বিজ্ঞান গবেষণা।

আন্তর্জাতিক একটি র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থান অর্জনের নেপথ্য কারিগর অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামকে তাঁর এই নিরন্তর প্রচেষ্টার জন্য বড়-ছোট কোনো সংবর্ধনা জ্ঞাপনের আয়োজনই আমাদের চোখে পড়েনি। তা সত্ত্বেও তোফাজ্জল ইসলামরা দমে যান না, কারণ তারা যে দেশের খাঁটি কৃষকেরই সন্তান। ফসলের দরপতনে ব্যথিত কৃষকরা যেমন আবারও ফসল আবাদে থেমে থাকেন না তেমনি অধ্যাপক ইসলামরাও হয়তো স্বীকৃতির পরোয়া না করেই মনোনিবেশন করবেন নতুন গবেষণায়। দেশকে এগিয়ে নিতে তোফাজ্জাল ইসলামদের এই প্রচেষ্টার প্রতি আমাদের অবনত শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর