কোভিড-১৯ উদ্ভূত দারিদ্র্য মোকাবিলায় ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান ও শিশির রেজা | 2023-08-31 02:59:52

করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সারা বিশ্বকেই ওলটপালট করে ছেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে করোনা ভাইরাস রোগটি শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে এটি শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। সে হিসেবে আজ পর্যন্ত অর্থাৎ ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত এক বছর তিন মাসের মত সময় ধরে এই রোগটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটার-এর তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ১৬৭,৫৮৯,৬৮৭ এরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৩,৪৭৯,৭৯২ জনেরও অধিক এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৭৮৯,০৮০ এরও অধিক সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১২,৩৭৬ এরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

কোভিড-১৯ আমাদের চিরচেনা জগৎটাকে সবদিক দিয়ে অপরিচিত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এই রোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। শুধু আর্থিক দিক থেকেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এই রোগের অভিঘাত ব্যাপকতর। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই ১৫ মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা হয়ত আরো বেশি।

এই বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোকাবিলায় ক্ষুদ্র্ঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত ক্ষুদ্র্ঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, আমরা জানি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে এদেশের দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো (এনজিও) ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে। এনজিওগুলো শুরুতে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসন ও জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করার জন্য ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। বর্তমানে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো বহুমুখী সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম তার মধ্যে অন্যতম। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এটি যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং, একথা বলা যায় যে, বর্তমান দারিদ্র্য অবস্থা মোকাবিলায়ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে, দেশব্যাপী প্রায় সাত শতাধিক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রায় ৩ কোটি দরিদ্র, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেছে। এ ক্ষুদ্রঋণ প্রাপ্ত পরিবারগুলো উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম যেমন হাঁস-মুরগির ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, সবজি বাগান, মাছ চাষ, দোকান ইত্যাদি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে নিজেরাও যেমন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, তেমনই দেশজ উৎপাদনেও সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ফলে যেসব পরিবার দরিদ্র ও হতদরিদ্র ছিল তাদের এক বিশাল অংশেরই দারিদ্র্য নিরসন হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি কেউ কেউ অন্যদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি ও মহাজনি ঋণগ্রস্ত হাত স্বাবলম্বী কর্মীর হাতে পরিণত হয়েছে। এ ঋণে তারা হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ও মাছ চাষসহ সবজি উৎপাদন করে নিজেরাই শুধু স্বাবলম্বী হয়নি, দেশের জাতীয় উৎপাদনেও নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্ত করেছে।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। তাদের একমাত্র ভরসা বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণগ্রহণ। যার যোগান দেয় এদেশের এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্র্ঋণ ও বিভিন্ন বেসরকারি আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। এই ঋণগ্রহণের মাধ্যমে তারা শুধু আর্থিকভাবেই দারিদ্র্য দূর করেনি, তারা এখন সামাজিক সচেতনতার বেষ্টনীতেও অবস্থান করছে। তারা পরিবারের স্বাস্থ্য, সন্তানের শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও শৌচাগার ব্যবহারে সচেতন হয়েছে। নিজেরা সামাজিকভাবে মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। সর্বোপরি আর্থিক সচ্ছলতা তাদের ‘মানুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে এবং এই সবই সম্ভব হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে।

প্রকাশিত অপর এক নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে, প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত। প্রতি গ্রাহকের পরিবারে পাঁচজন সদস্য ধরে নিয়ে হিসেব করলে ক্ষুদ্রঋণের সেবাপ্রাপ্ত মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ। প্রায় ২৫ লাখ কর্মী ক্ষুদ্রঋণ খাতে কাজ করছেন এবং তাদের পরিবারসহ হিসেব করলে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষের জীবিকার সংস্থান করছে এই খাত।

এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও সামাজিক উদ্যোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব। গ্রামাঞ্চলে নারীর উন্নয়ন ও অধিকার আদায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে অর্থায়ন, প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিদেশ গমনে সহায়তা প্রদানে এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর তাই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় যে সেক্টরটি দেশ-বিদেশে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত তা হলো এদেশের এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ।

এসব সত্ত্বেও, সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং জবাবদিহিতা নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারি এনজিওগুলো একটি সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা এমআরএ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এমআরএ'র পাশাপাশি আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফ (পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন) দ্বারাও আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং তাদের একটি জবাবদিহিতা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতেও নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল ও ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয় এসব সংস্থাকে। সব ক্ষেত্রেই সংস্থাগুলোকে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। আয়কর অফিসেও সংস্থাগুলোকে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এই নানামুখী ও কঠোর জবাবদিহিতা কাঠামোর মধ্যে আসলে খেয়াল খুশি মতো ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঋণ প্রদান ও সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করছে- এ ধরনের যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক বেশি জবাবদিহিতা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।

বিগত প্রায় দেড় দশকের ব্যক্তিগত আভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন নজির নেই। বরং ঋণের টাকা আয় বর্ধন মূলক কাজে বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী কর্মকর্তাদের তদারকি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই তাদের দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠে স্বাবলম্বী হয়েছে। যেসব পরিবার আগে তিনবেলা খেতে পারতনা তারা এখন তিনবেলা পেটভরে খেতে পারে। সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে, অসুস্থ্য হলে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে, অনেকেই তাদের ঋণের টাকা সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে লাভবান হয়ে বাড়ি ঘরের উন্নয়ন করেছে, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিকও হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। বিনোদনের জন্য টেলিভিশন আছে এমনকি অনেক পরিবারে ফ্রিজ ব্যবহার করতেও দেখা গেছে। সুতরাং একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে প্রযোজন সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও ঋণ প্রদানের প্রবাহ ঠিক রাখা।

মহামারি করোনার আঘাতে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এবং নব সৃষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এনে দারিদ্র্য অবস্থা মোকাবিলা করা ও উত্তরণ সম্ভব বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বরাদ্ধ দিয়েছে। ফলে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার কারণে সৃষ্ট দরিদ্রদের মাঝে নতুন করে স্বল্প সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ক্ষুদঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ঋণ প্রদানের পাশাপাশি তারা গ্রাহকদের করোনা ভাইরাস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সবই আছে। কিন্তু করোনার কারণে তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি ও অকৃষি খাতে যুক্ত এই বিশাল জনশক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ ও জীবনযাপনের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম জোরদার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং কোভিড-১৯ উদ্ভূত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের নীতিগত সহায়তা ও আার্থিক প্রণোদনা।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর