বিশ্বশান্তি রক্ষায় অনন্য বাংলাদেশ

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 14:24:54

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের (https://peacekeeping.un.org/en/bangladesh) প্রচ্ছদে জ্বলজ্বল করছে বাংলাদেশি সাহসিক শান্তিরক্ষীদের মুখচ্ছবি আর নিচে উৎকীর্ণ স্বীকৃতি: 'Thank You Bangladesh for Your Service and Sacrifice.' 

বর্তমান সংঘাত-পীড়িত বিশ্বে শান্তিরক্ষায় অনন্য ও অগ্রণী নাম বাংলাদেশ। নেতৃত্ব, দক্ষতা, ত্যাগ ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বীর ও সাহসী শান্তিরক্ষীগণ বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উত্তীর্ণ করেছেন আস্থা ও বিশ্বাসের উচ্চতর মর্যাদায়।

১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। ওই বছর ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক দলে ১৫ জন সামরিক পর্যবেক্ষক পাঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

সেই থেকে শুরু শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে লাল-সবুজের বাংলাদেশের যাত্রা। এর পর যত দিন পার হয়েছে, ততই আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় দেশের সাফল্যে নতুন নতুন পালক যুক্ত হয়েছে, যা বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন এক সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।

সেনাবাহিনীর পর নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। আর পুলিশ সদস্যগণ নামিবিয়া মিশনের মধ্য দিয়ে ১৯৮৯ সালে শান্তিরক্ষী মিশনে যাত্রা শুরু করেন। পুরুষের পাশাপাশি বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীরাও অংশ নিয়েছেন এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনির প্রতীক 'ব্লু হেলমেট' ধারণ করে সকল বাহিনির সদস্যগণই নিজেদের যোগ্যতার সাক্ষর রাখছেন।

ফলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম শীর্ষে চলে আসে। তিন যুগের কিছু বেশি অভিজ্ঞতায় শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে নেতৃত্ব স্থানীয় অবস্থান। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ মিলে বর্তমানে ছয় হাজার ৭৩১ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বিশ্বের নানা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সুনামের নিরিখে বর্তমানে ৮টি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া দক্ষিণ সুদানে ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে মেজর জেনারেল পদবীর কর্মকর্তা এবং কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও দক্ষিণ সুদানে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদবীর কর্মকর্তা নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনী তাদের দক্ষতার কারণেই আজকে আমরা এই উচ্চপদ পেতে সক্ষম হয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'আমরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধীনে বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সদা প্রস্তুত। এটা আমি জাতিসংঘকে আরও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই।'

বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হওয়াটা একই সঙ্গে গর্বের ও গৌরবের এবং অন্যদিকে খুবই চ্যালেঞ্জিং। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই সুদক্ষ, সুপ্রশিক্ষিত, পেশাদার নৈপুণ্যে দীপ্তিময় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্ব শান্তিরক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

নানা ভয়-শঙ্কা ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সংঘাত মোকাবিলায় তারা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ভূমিকা। সংঘাতময় বিভিন্ন দেশের রাস্তাঘাট, স্থাপনা নির্মাণ ও  চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অনুকরণীয় দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের এই বহুমুখী কৃতিত্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘাত নিরসনের সকল আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে চর্চিত।

কৃতিত্বের সঙ্গে সাফল্য পেতে জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তিরক্ষা অভিযানে বাংলাদেশের মোট ৮৮ জন জন শান্তিরক্ষী বাহিনির সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এদের মধ্যে চুরাশি জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর, ১ জন নৌবাহিনীর, এবং তিন জন ছিলেন বিমান বাহিনীর  সদস্য ছিলেন। নামিবিয়ায় UNTAG বাংলাদেশ বাহিনীর নেতা লেফটেনেন্ট কর্নেল মোঃ ফয়জুল করিম উইন্ডহোক, নামিবিয়া ১৯৮৯ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী প্রথম বাংলাদেশী অফিসার যিনি বিদেশে মিশন যারা মারা যান।

বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশ বাহিনীর অবদানকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের একাধিক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের কমান্ডার এবং সিনিয়র সামরিক লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, শান্তিরক্ষা সম্প্রদায়ে বাংলাদেশের সফলতা ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই চলছে।

লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর