বাজেটে কর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব

, যুক্তিতর্ক

মো. মাজেদুল হক | 2023-08-26 09:56:54

জাতীয় বাজেট বাংলাদেশ সরকার প্রণীত একটি বার্ষিক দলিল- যাতে রাষ্ট্রের বাৎসরিক  আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। জাতীয় বাজেটের মূল অংশ দুটি। প্রথম অংশ রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত। এই অংশে সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থা ও আদায় সংক্রান্ত প্রস্তাব সমূহের বিবৃতি থাকে। দ্বিতীয় অংশে থাকে সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাবসমূহ। রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে আয়কর ও  ভ্যাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য প্রতি অর্থবছরে বাজেট প্রণনয়নের সময় পরিকল্পনা করা হয়। এ পরিকল্পনা মূলত করা হয় অনিয়মিত করদাতাদের জন্য। সম্পদ এর পরিমান যারা প্রদর্শন করতে চান না তাদেরকে নিয়ে যত জল্পনা-কল্পনা। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

তবে আমি মনে করি এ প্রক্রিয়া শেষ হওয়া উচিৎ। প্রতি বছর প্রাক-বাজেট আলোচনায় আমন্ত্রিত বক্তারা কালো টাকা সাদা না করার পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু, যখন বাজেট পাশ হয় তখন দেখা যায় কালো টাকা সাদা করার বিধান যথারীতি বহাল থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী বলেছেন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আগামী আগামী অর্থবছরেও থাকছে।

তাঁর ভাষায় ‘যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ সুযোগ থাকবে। মানুষের অপ্রদর্শিত আয় হালাল করার মাধ্যমে সরকার যদি রাজস্ব আয় বাড়াতে পাওে, তাতে অর্থনীতির তথা দেশের  জন্য ভাল। তবে দুঃসংবাদও রয়েছে। নিয়মিত করদাতাদের চেয়ে অনিয়মিত করদাতাদের সুবিধা বেশি দিলে নিয়মিত করদাতারা কর প্রদানে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। এত ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য বাড়তে থাকবে। বিগত ৪৫ বছরে সরকার ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। এ থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছে মাত্র ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এক শ্রেণির মানুষ আছে তারা সবসময় সরকারের দেওয়া সুবিধাগুলো ভোগ করার জন্য বসে থাকে। এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশের আয়কর আইনানুযায়ী আয়ের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। কিন্তু, যারা কর ফাঁকি দেন তারা ১০ শতাংশ হারে দিচ্ছেন। এটা আমার কাছে কখনো যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। কম হারে কর দিয়ে বিলিয়ন টাকার অপ্রদর্শিত সম্পদ তারা হালাল করে নিচ্ছে। কম হারে আয়কর দিয়ে তারা তাদের সম্পদ বাড়াচ্ছে। এতে করে অর্থনীতিতে বিপজ্জনক বৈষেম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের উপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোন সিকিউরিটিজের উপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রথম ছয় মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা কর দিয়ে বৈধ করেছেন ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করার মোট টাকার পরিমান প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার।  এটা অর্জিত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে।

দুঃখজনক যে , বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি হার অনেক বছর ধরে ১০ শতাংশের কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করছে। সরকার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এটাকে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য। নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের ট্যাক্স-জিডিপি হার ৫০ শতাংশের উপরে। কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে কর কাঠামো এবং কর ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে পারলে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি হার বেড়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নাই। গ্লোবাল ফাইন্যানসিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি তথ্যমতে , বাংলাদেশ থেকে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গড়ে ৭.৫৩ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।

এছাড়াও, সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশিরা ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি ডলার , ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার এবং ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ডলার জমা রেখেছে।

সুইস ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশিদের জমানো টাকার পরিমান দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪ শত ২৭ কোটি টাকা। বিদেশে অবস্থানরত আয়কর ফাঁকিবাজদের ( যার বাংলাদেশি) ধরার জন্য ২০১৮ সালে সরকার বাংলাদেশ দুতাবাসগুলোতে ‘ট্যাক্স ডিটেকটিভ’ বসানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ চালিয়ে যাওযার কথা। জানি না এখন কি অগ্রগতি। এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে অবশ্যই রাজস্ব আয় ক্রমানয়ে বেড়ে যাবে। কর-রাজস্ব ও করবহিভর্’ত রাজস্ব আয়ের সেসব খাত অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, যেসব খাত থেকে আয়করের কথা কখনও ভাবা হয় না ( যেমন সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফার উপর কর, কালোটাকা উদ্ধার, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ইত্যাদি) এবং যেসব খাত থেকে কোনো আয় আসে না অথচ সম্ভাবনা অনেক। একই সাথে সেসব খাত চিহ্নিত করা প্রয়োজন যেসব খাত থেকে স্বল্প আয় আসে, অথচ প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক যদি একটু উদ্যমী হওয়া যায় এবং কর-রাজস্ব ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা যায়। বাংলাদেশে আয়-বৈষম্য এবং ধনকুবেরের সংখ্যা অতিদ্রুত বেড়ে চলেছে। এটা সমাধান না করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সামনের দিনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা  ‘ ওয়েলথ এক্স’ ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৮.৩ শতাংশ হারে।

যেখানে গনচীনে ধনকুবেরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৩.৪ শতাংশ। অর্থনীতিতে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয় , যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং জিনি সহগ। কোন অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন নীতি-নির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়-বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক জিনি সহগ বেড়ে ০.৪৮৩ এ পৌঁছেছে। করোনা মহামারীর কারণে আয়-বৈষম্য অতিদ্রুত বেড়ে গেছে। ৩১ মে ২০২০ নাগাদ জিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৬৩৫ এ । ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বানিজ্যে আধিপাত্য বিস্তার করেছিল। ঐ ২২ পরিবারের মধ্যে ২টি পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্থানের, তা-ও ১টি ছিল অবাঙালি। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ঐ সংখ্যা ৫৪,৭২৭ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব প্রকাশিত হয়েছে।  ৯ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে বিশ্বখ্যাত এনজিও –অক্সফাম কর্তৃক বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি সূচকের বিবেচনায় ১৫৭টি দেশের যে র‌্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৮ ( খুব হতাশাজনক)। সামাজিক খাতসমূহে ব্যয়, করারোপ এবং শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সরকারে প্রয়াস- এই ৩টি বিষয়ের ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি করা হয়েছিল। এ থেকে বলা যায় যে, কর ব্যবস্থাপনার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দিয়ে নিয়মিত করদাতাদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করতে হবে। যারা অপ্রদর্শিত সম্পদ প্রদর্শন করতে চায় তাদের উপর করের হার বেশী নির্ধারণ করা যেতে পারে। এত করে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে অন্যদিকে নিয়মিত করদাতারা উৎসাহিত হবেন। একমাত্র কর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আয়-বৈষম্য কমানো সম্ভব।

পরিশেষে  বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ বিনির্মানের বিষয়টি ছিল অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। আশা করি ২০২১-২২ বাজেটের মাধ্যমে ভাল একটা কর কাঠামো দেখতে পাবো যার মাধ্যমে একদিকে যেমন রাজস্ব বাড়বে অন্যদিকে চলমান আয়-বৈষম্য কমে যাবে।

লেখক: মো. মাজেদুল হক, অর্থনীতি বিশ্লেষক।           

এ সম্পর্কিত আরও খবর