হালাল ফ্লাইট, হালাল সেবা নাকি হালাল এয়ারলাইন্স

, যুক্তিতর্ক

মো. কামরুল ইসলাম | 2023-08-26 16:28:26

হালাল শব্দটা শুনলেই কেমন জানি নিজেকে শুদ্ধ শুদ্ধ মনে হয়। আর হালাল এয়ারলাইন্স নামের সাথেই যেন রয়েছে শুদ্ধ জীবনাচার সমৃদ্ধ সেবা। আর হালাল ফ্লাইটে ভ্রমণ যেন পরিশুদ্ধতায় ভরা। যতক্ষণ ভ্রমণ ততক্ষণ যেন পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন।

বিশ্বের অনেক দেশেই হালাল এয়ারলাইন্স হিসেবে অনেক এয়ারলাইন্স নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলো কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে খুব একটা গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বিশ্বে অনেক এয়ারলাইন্স সরাসরি হালাল এয়ারলাইন্স না হলেও হালাল ফ্লাইট হিসেবে হালাল সেবা দিয়ে থাকে। সাধারণত শরিয়াহ ভিত্তিক ধর্মীয় রীতিনীতির আলোকে হালাল খাবার কিংবা হালাল সেবা নির্ধারণ করা হয়।

হালাল এয়ারলাইন্স কিংবা হালাল ফ্লাইট এর প্রধান ও অন্যতম শর্ত হচ্ছে হালাল খাবার। একটি এয়ারলাইন্সকে হালাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এয়ারলাইন্সের ইন-ফ্লাইট সার্ভিসের অন্যতম সেবা হচ্ছে হালাল খাবার। একটি ফ্লাইটের ইন-ফ্লাইট সার্ভিস কত ভালো কিংবা উন্নত তার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে ফ্লাইটের ফুড সার্ভিস কত উন্নত। ফ্লাইটে হালাল খাবার সরবরাহের জন্য হালাল উপায়ে মাংস সংগ্রহ করতে হয়। ককপিটসহ ইন-ফ্লাইটে অ্যালকোহল কিংবা ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রেখে ফলের জুস কিংবা ফল জাতীয় খাবার সরবরাহের আধিক্য থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

একটি হালাল এয়ারলাইন্সে যেকোনো ধর্মের ব্যক্তিই কেবিন ক্রু হতে পারে। কিন্তু কেবিন ক্রুর পরিধেয় বস্ত্র কিংবা ইউনিফর্ম অবশ্যই মার্জিত রুচি সম্পন্ন হতে হবে। মুসলিম কেবিন ক্রুরা সাধারণত হিজাব পরিধান করে থাকে।

নামাজ পড়ার সকল সুযোগ-সুবিধা রেখে নামাজের সময়সূচি ঘোষণা করা হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, যে দেশের ওপর দিয়ে ফ্লাই করবে সে দেশের স্থানীয় সময়কে বিবেচনা করেই নামাজের সময় নির্ধারিত হবে। হালাল এয়ারলাইন্সে কিংবা হালাল ফ্লাইট উড্ডয়নের পূর্বে মোনাজাত এর ব্যবস্থা থাকে। ককপিট ক্রুর মাধ্যমে অথবা রেকর্ডেড মোনাজাত পরিচালনার ব্যবস্থা করে থাকে। জায়নামাজ সহ নামাজের জায়গা নির্ধারিত রাখা প্রয়োজন অথবা অনুরোধক্রমে জায়গার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এয়ারক্রাফটের অবকাঠামোর কারণে অতিরিক্ত জায়গা সম্ভব না হলে মুসাফির ভ্রমণের নিয়মানুযায়ী নামাজ আদায় করে নিতে হয়। ওযু করার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রাখা হয়। বিশ্রামাগারে পর্যাপ্ত জায়গাসহ হালাল সাবান রাখা হয়ে থাকে।

হালাল সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যাত্রীদের জন্য পা রাখার অতিরিক্ত জায়গা রাখার মাধ্যমে আরামদায়ক আসন ব্যবস্থা জরুরি। যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইসলামিক বই, ম্যাগাজিনসহ, নানাবিধ ইসলামিক বিনোদনের কনটেন্টস থাকে, যার মাধ্যমে হালাল সেবার অনুভূতি পাওয়া যায়।

সুনির্দিষ্ট ভাবে হালাল এয়ারলাইন্স নিয়ে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তারপরও বিশ্বে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স যেমন রয়্যাল ব্রুনাই এয়ারলাইন্স, সৌদি এ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স, ইরান এয়ার এর ফ্লাইটগুলো হালাল ফ্লাইট হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। আর মালয়শিয়ার রায়ানি এয়ার শরিয়াহ ভিত্তিক হালাল এয়ারলাইন্স হিসেবে ২০১৬ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং লংকাউয়ি থেকে কুয়ালালামপুর আর কোটা বেহেরু শহরে সংস্থাটির বিমান চলাচল শুরু করেছিলো। বিভিন্ন জটিলতায় ছয় মাসের বেশি রায়ানি এয়ারলাইন্স চালাতে সক্ষম হয়নি।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে এমনকি উন্নত বিশ্বেও কেবিন ক্রু এর পেশাটাকে প্রথম শ্রেণীর পেশা হিসেবে সাধারণ জনগণ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। বাঁকা চোখে দেখেই অভ্যস্ত। এ অবস্থা থেকে দৃষ্টি পরিবর্তনের একটা সুযোগ রয়েছে হালাল এয়ারলাইন্স এর ধারণায়। সারা বিশ্বের যেকোনো দেশেই বিশেষ করে যেসব দেশ অমুসলিম অধ্যুষিত সেখানেও সুনির্দিষ্টভাবে হালাল রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যাতে করে মুসলিম জনগণ হালাল খাবারের বিভ্রান্তিতে না পড়েন। হালাল এয়ারলাইন্স এর খাবার মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্যই প্রযোজ্য এখানে শুধু পছন্দের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অমুসলিম দেশের এয়ারলাইন্সেও খাবারের পছন্দ তালিকা থাকে হালাল এয়ারলাইন্সেও তেমনি। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব এয়ারলাইন্সে পানীয়র তালিকায় অ্যালকোহলের উপস্থিতি নাই।

রমজান মাসে ইফতারের সময় মুসলিম দেশের এয়ারলাইন্সগুলো শুধু নয় অমুসলিম দেশের এয়ারলাইন্সগুলো মুসলমান যাত্রীদের সুবিধার্থে মাগরিবের আযান প্রচারের সময় ঘোষণা করা হয় যাতে রোজাদার ব্যক্তিগণ ইফতার করতে পারেন। এমনকি ইফতারের জন্য মুসলমানদের রীতি অনুযায়ী ইফতারিও দিয়ে থাকে। তেমনিভাবে রোজাদারদের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে সেহরির সময়কে গুরুত্ব দিয়েও সময় প্রচার করে থাকে। বাস্তবে হালাল ফ্লাইট, হালাল সেবা সাম্প্রদায়িক নাকি অসাম্প্রদায়িক তা হচ্ছে মানুষের অনুভূতিতে। যখন এয়ারলাইন্সগুলো কোনো গন্তব্যে যাত্রা করে তখন মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেই যাত্রারম্ভ করে থাকে। আমরা যখন কোনো বিপদে পড়ি তখন সৃষ্টিকর্তাকেই স্মরণ করি। এখানে যার যার অন্তরাত্মা যেভাবে স্মরণ করেন।

আরব এয়ারলাইন্সগুলো সাধারণত সকলে হালাল খাবার দিয়ে থাকে। এছাড়া বিশ্বের প্রায় অনেক এয়ারলাইনন্সের পছন্দ তালিকা রয়েছে কিন্তু হালাল খাবার পেতে হলে যাত্রা শুরুর কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগে অর্ডার দিতে হয়। উদাহরণ হিসেবে এয়ার এশিয়ার সকল ফ্লাইটের খাবারই হালাল কিন্তু ২৪ ঘণ্টা আগে অর্ডার দিতে হবে, ব্যতিক্রম হিসেবে এয়ার এশিয়া জাপান ও ফিলিপাইন্স এয়ার এশিয়ার সব খাবার হালাল নয়। এয়ারলাইন্সগুলোতে সাধারণত হালাল খাবার হিসেবে উল্লেখ থাকে All Meals are Halal, Fully Certified, Not Certified, Verified, Verbally Certified by Crew, non-vegetarian meals are strictly halal. এখানে পুরোপুরি নির্ভর করে বিশ্বাস আর এয়ারলাইন্স এর আস্থার ওপর।

ISA- Islamic Services of America উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত অনেক পুরাতন ও জনপ্রিয় হালাল সার্টিফায়ারস। সারাবিশ্বের অনেক উন্নত ব্র্যান্ডের খাবার কোম্পানিসহ অনেক এয়ারলাইন্স এর খাবারের এর সার্টিফিকেশন দিয়ে থাকে ISA।

হালাল খাবার, হালাল ফ্লাইট, হালাল এয়ারলাইন্স, হালাল সেবার ধারাবাহিকতায় বিশ্বের অনেক দেশেই হালাল ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করছে। পর্যটকদের রুচি, চাহিদার ভিন্নতার কারণে আজ সময়ের প্রয়োজনে হালাল ট্যুরিজমও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আবাসন সুবিধাসহ, খাবার, পরিবেশ সব কিছুই হালাল সেবার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অনেক দেশের এয়ারলাইন্সই হালাল ফ্লাইট, হালাল সেবা দিয়ে থাকে কিন্তু হালাল এয়ারলাইন্স হিসেবে নিজেদেরকে প্রচার করতে চায় না। কারণ হিসেবে হালাল শব্দটার সাথে একটি সাম্প্রদায়িক অনুভূতির স্পর্শ উপলব্ধি করে অনেকেই। ফলে ব্যবসায়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হালাল এয়ারলাইন্স না হলেও হালাল ফ্লাইট, হালাল সেবার প্রত্যাশা অনেকেরই।

লেখক মো. কামরুল ইসলাম মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

এ সম্পর্কিত আরও খবর