টিকে থাকার লড়াইটা কি শুধু বেসরকারি বিমান সংস্থার?

, যুক্তিতর্ক

মো. কামরুল ইসলাম | 2023-08-28 08:50:35

লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড অনেক প্রচলিত একটা শব্দ বাংলাদেশ এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে। এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছেই দু’টো অংশ। জাতীয় বিমান সংস্থা আর বেসরকারি বিমান সংস্থা। জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কে পথ প্রদর্শক হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো। সব কিছুর পথ প্রদর্শক ভাবলে আবার নীতি নির্ধারক শ্রেণি বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশকে অনেকেই শতভাগ পথ প্রদর্শক ভেবে একসময় ব্যবসা ঘুটিয়ে এভিয়েশন মার্কেট থেকে চলেও গেছে। মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিভিল এভিয়েশন, পদ্মা ওয়েল এর মতো জাতীয় সংস্থাগুলো। আর বদনামের ভাগিদার হয়েছে বর্তমানে টিকে থাকা বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো।

সাম্প্রতিককালে একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর কাছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পাবে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। এখানে বিভিন্ন ধরনের চার্জ, ট্যাক্স ও সারচার্জ বাবদ পাওনা রয়েছে। আর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা পাবে পদ্মা ওয়েল কোম্পানি জেট ফুয়েলের মূল্য বাবদ। বন্ধ হওয়া তিনটি এয়ারলাইন্স জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজসহ এ্যারোবেঙ্গল এয়ারলাইন্স, এয়ার পারাবাত, বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারওয়েজের কাছে প্রায় নয়শত কোটি টাকা পাবে রেগুলেটরী অথরিটি সিভিল এভিয়েশন। এখানে উল্লেখ্য বর্তমানে পরিচালিত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভো এয়ার এর কাছে এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যালসহ অন্যান্য চার্জ বাবদ চলমান পাওনা মাত্র ২০ কোটি টাকা যা জাতীয় বিমান সংস্থার তুলনায় অতি নগন্য। পদ্মা ওয়েলের ভাষ্যমতে বেসরকারি বিমান সংস্থার কাছে কোনো ধরনের পাওনা নেই, যা লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের অসামঞ্জস্যতার এক উদাহরণ হয়ে থাকলো।

প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এর বয়স প্রায় ২৫ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি বললেই চলে কিন্তু জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোতভাবে সহায়তা করেছে এবং করছে। এয়ারক্রাফট ক্রয় করা থেকে শুরু করে কর্মচারীদের বেতন প্রদানেও সহায়তা করেছে রাষ্ট্র। কিন্তু প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে এভিয়েশন মার্কেট থেকে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলোকে ফিরিয়ে আনার কোনো লক্ষণ দেখতে পাইনি। অবশ্য ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বাংলাদেশের একমাত্র পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, যা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তালিকাভূক্ত। ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর লাখ লাখ শেয়ার হোল্ডারদের বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয় থেকে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছে। ভবিষ্যতই বলবে ডুবে যাওয়া তরীকে টেনে তোলে তীরে উঠানো যাবে কিনা। যদি যায় তা হবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি অভাবনীয় ঘটনা।

বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সকল এয়ারলাইন্সই চরম দূরাবস্থার মধ্যে পড়েছে। এই সংকটকালীন সময়ে বিশ্বের বহু এয়ারলাইন্স বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। খরচকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কর্মচারী ছাটাই একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাড়িয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখার জন্য এয়ারক্রাফটের কিস্তির টাকা, ইন্স্যুরেন্স এর খরচ, ব্যাংকের লোন, কর্মচারীদের বেতন, প্রশাসনিক খরচ, মেইটেন্যান্স খরচসহ সকল ধরনের খরচের জন্য প্রণোদনা হিসেবে হাজার কোটি টাকাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোরও অনুরূপ খরচ বিদ্যমান। বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো প্রণোদনার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ কমিয়ে কিংবা মওকুফ করে টিকে থাকার একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়ার অনুরোধ রেখেছিলো নীতি নির্ধারক মহলে। ২০২০ সালে স্বল্প সময়ের কিছু চার্জ মওকুফ করেছিলো যা জাতীয় বিমান সংস্থার তুলনায় খুবই নগন্য। জাতীয় বিমান সংস্থা যেমন এ দেশের নাগরিকদের সেবা দেয়ার জন্য সব সময় চেষ্টা করে থাকে তেমনি বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোও সর্বোতভাবে সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে থাকে। জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে বেসরকারি বিমান পরিবহনকেও টিকিয়ে রাখা সময়ের চাহিদা হয়ে উঠেছে। নতুবা এদেশের এভিয়েশনের মার্কেট শেয়ার বিদেশিদের কাছে চলে যাবে, ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৩০ ভাগ দেশীয় এয়ারলাইন্সের কাছে। এখানে যেমন বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স এর রয়েছে তেমনি বেসরকারি বিমান সংস্থারও অংশীদারিত্ব আছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ২৫ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এয়ারক্রাফটের মেইনটেন্যান্সসহ রেগুলার চেক করার জন্য কোনো প্যাসেঞ্জার এয়ারলাইন্স হ্যাঙ্গার ফ্যাসিলিটি পায় নাই। হ্যাঙ্গার এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে বলতে ৮ থেকে ৯টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশের রয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটি বিশালাকৃতি হ্যাঙ্গার। যেখানে নিজেদের প্রয়োজনীয়তাকে পরিপূর্ণতা দিয়ে অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে ঘণ্টা ভিত্তিক ভাড়া দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যেখান থেকে রেভিনিউ অর্জন করছে। প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্সই ফ্লাইট অপারেশন শুরু করার পূর্বেই হ্যাঙ্গার এর সুবিধা চেয়ে সিভিল এভিয়েশনের কাছে আবেদন করে থাকে। কিন্তু ফলপ্রসু কোনো রেজাল্ট প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো ইতিপূর্বে পায়নি। বর্তমান প্রশাসন খুব শীঘ্রই প্যাসেঞ্জার এয়ারলাইন্সের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে হ্যাঙ্গার বরাদ্দ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। যা বেসরকারি বিমান সংস্থার কাছ থেকে সাধুবাদ পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো নিজস্ব অর্থায়নে সারা দেশের অবকাঠামো গড়ে তুলে। আয়ের অংশ থেকেই প্রতিটি ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। বিশেষ করে বিমান বন্দরের অভ্যন্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় অফিস স্থাপনার জন্য একটি বিশাল খরচ বহন করতে হয়। কিন্তু জাতীয় বিমান সংস্থার কর্পোরেট অফিসসহ বিভাগীয় কিংবা জেলা শহরের অফিস স্থাপনাগুলো অধিকাংশই সরকারের নিজস্ব সম্পত্তি। এখানেও বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের তারতম্যের মধ্যে পড়ে আছে।

হজ ফ্লাইট পরিচালনার ব্যাপারে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো এক পাক্ষিক সিদ্ধান্তের বেড়াজালে আটকে আছে বছরের পর বছর। বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত বিমান সংস্থাগুলো সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনোটিই কোনো পর্যায়ে থার্ড ক্যারিয়ার হিসাবে পরিগণিত হওয়ার কথা না। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি থাকলে থার্ড ক্যারিয়ার হওয়ার সুযোগ নেই। সৌদি আরবের কোনো এয়ারলাইন্স এর ক্ষেত্রেও তাই। মধ্যপ্রোচ্য কিংবা অন্য কোনো দেশে যদি কোনো এয়ারলাইন্স ট্রানজিটের জন্য ল্যান্ডিং করে তবে সেই এয়ারলাইন্সকে থার্ড ক্যারিয়ার হিসেবে বলা যায়। এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার, কুয়েত এয়ারওয়েজ কিংবা অন্য কোনো এয়ারলাইন্স এক্ষেত্রে থার্ড ক্যারিয়ার হতে পারে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতি বছরের আয়ের একটা বিশাল অংশ হজ ফ্লাইট থেকে অর্জন করে কিন্তু বেসরকারি বিমান সংস্থা হজ ফ্লাইটের মতো লাভজনক একটি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিমান বাংলাদেশের একটি আয়ের একটি বড় খাত। নিজেদের ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ছাড়াও বাংলাদেশে আগত প্রায় সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এর সেবা দিয়ে থাকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এখানে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করার সুযোগ তৈরি হয় নাই। যা বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো অতিরিক্ত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সরকারি কিংবা বেসরকারি বিমানসংস্থা চিন্তা না করে যদি দেশীয় বিমান সংস্থা চিন্তা করা হয়, লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেয়া হয় তবে বাংলাদেশ এভিয়েশনের আন্তর্জাতিক রুটের বর্তমানের যে মার্কেট শেয়ার তার থেকে ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশার বাতিঘর বাংলাদেশ এভিয়েশনের দিকপাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স হোক বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর কাছে সত্যিকার অর্থেই পথ প্রদর্শক। ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। বিশাল একটি এভিয়েশন মার্কেটের অংশীদারিত্ব নেয়ার জন্য বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য এগিয়ে আসছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় শক্ত অবস্থা নিতে পারবে।               

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

এ সম্পর্কিত আরও খবর