সাকিব রোল মডেল নন

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 22:17:01

আশির দশকে যারা আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচ দেখেছেন ঢাকায়, তারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি সেউ উত্তেজনার কথা। ফুটবল হোক আর ক্রিকেট, আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক, পরপর দুদিন পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ। ম্যাচের দিন দুই অধিনায়করে সাক্ষাৎকারসহ ‘আজ আবাহনী-মোহামেডান দ্ব্রৈরথ’, আর পরদিন হতো ‘স্টেডিয়াম এলাকা রণক্ষেত্র’। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের এই উত্তেজনা, এই মারামারি নিয়ে তখন অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এখন সেই উত্তেজনা আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। অনেকদিন পর আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ উত্তেজনার কারণে পত্রিকার প্রথম পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। তবে যেভাবে সেটা পেয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত। খেলাধুলা ভালোবাসেন, এমন কেউ কখনো এমন শিরোনামের পুনরাবৃত্তি চাইবেন না।

এক সিগারেটের আগুন দিয়ে যারা আরেক সিগারেট জ্বালান, তাদের বলে চেইন স্মোকার। সেই বিবেচনায় সাকিব আল হাসানকে ‘চেইন বিতার্কিক’ উপাধি দেয়া যেতে পারে। বিতর্ক যেন তার নিত্যসঙ্গী। এক বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক বিতর্কে জড়ান। ব্যাপারটা এমন নয় যে কেউ ষড়যন্ত্র করে তাকে বিতর্কে ফাঁসিয়ে দেন। বরং ঘটনা উল্টো। সাকিব আল হাসান নিজে যেচে বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানান। অনেকে বলেন, বিতর্ক না হলে সাকিব অনুপ্রেরণা পান না। অনুপ্রেরণা পান কি পান না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ; তবে সাকিব আল হাসানের মত তারকা যে সব বিতর্কে জড়ান, তা তার জন্য তো বটেই, দেষের ক্রিকেটের জন্যও ক্ষতিকর। দেশের হয়ে না খেলে আইপিএল খেলতে যাওয়ার বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই বিসিবির জৈব সুরক্ষা ভেঙে সতর্কবাণী শুনেছেন। করোনাভাইরাস থেকে খেলোয়াড়দের সুরক্ষা দিতে বিসিবি ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বায়ো বাবল তৈরি করেছে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দুই নেট বোলার নিয়ে গেছেন প্র্যাকটিসে। সেই সতর্কবাণী কোনো কাজে আসেনি। আসলে সাকিব কখনো কোনো সতর্কবাণীকেই পাত্তা দেন না। সাকিবের মাঠের পারফরম্যান্সের পরিসংখ্যান যেমন লম্বা, তার বিতর্কের তালিকাও কম লম্বা নয়। সাকিবের কোন পারফরম্যান্সের চেয়ে কোনটা ভালো, এই তালিকা করতে গিয়ে যেমন আমাদের গলদঘর্ম হতে হয়; তেমনি তার কোন বিতর্কের চেয়ে কোনটা খারাপ তা নিয়ে ঝামেলা বাধে। গত শুক্রবার আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে সাকিব যা করেছেন, তার উদাহরণ খুঁজতে কষ্ট হবে। আর তিনি হঠাৎ কোনো মানবিক ভুল করেছেন, ব্যাপারটি এমনও নয়। বারবার আইন ভেঙেছেন। আম্পায়ার এলবিডব্লিউর আবেদন প্রত্যাখ্যান করায় লাথি মেরে উইকেট ভেঙে দিয়েছেন। মুখে আম্পায়ারকে কী বলেছেন্, তা শুনতে না পেলেও ধারণা করি, তা সুখকর কোনো আলাপ ছিল না। পরের ওভারে আম্পায়ার বৃষ্টির জন্য খেলা থামাতে চাইলে সাকিব তেড়ে গিয়ে তিনটি স্ট্যাম্পই তুলে আছাড় মেরেছেন। পরে ড্রেসিং রুমে ফেরার সময় আবাহনী সমর্থকদের দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছেন। মারতে গেছেন আবাহনীর কোচ ও বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনকে। সব মিলিয়ে যেন বিতর্কের ধারাবাহিক।

অবশ্য পরে নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে সাকিব লিখেছেন, ‘প্রিয় ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা, যারাই আজকের ম্যাচে আমার আচরণ দেখে কষ্ট পেয়েছেন বিশেষ করে ঘরে বসে যারা খেলা দেখেছেন, তাদের কাছে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার মতো অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে এমনটা মোটেও কাম্য নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রতিকুল পরিবেশে এমনটা হতেই পারে। এমন ভুলের জন্য সকল দল, কর্তৃপক্ষ, টুর্নামেন্ট সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা ও অর্গানাইজিং কমিটির কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আশা করি ভবিষ্যতে এমন কোন কাজে আমি আর জড়াবোনা। সকলের জন্য ভালোবাসা।‘ তবে তার অপরাধের যে মাত্রা, তাতে নিছক ক্ষমা চেয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই, পানওনি। সাকিব আল হাসানকে ঘরোয়া ক্রিকেটে চার ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অপরাধ করেছেন, শাস্তি পেয়েছেন। ব্যাপারটা এখানে মিটে গেলেই ভালো। কিন্তু সাকিব নিজের যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন, তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, এটা শেষ নয়। সাকিবের বয়স ৩৪, বাংলাদেশের সিনিয়র ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আছেন দেড় দশক। কিন্তু এমন সব কান্ড-কারখানা করেন, মনে হয় তিনি কিছুই জানেন না। জুয়ারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যে অপরাধ, সেটা তিনি জানেন না। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা যে খারাপ সেটা তিনি জানেন না। উইকেট ভেঙে ফেলা যে অপরাধ সেটা তিনি জানেন না। করোনার মধ্যে পুজা উদ্বোধন করতে কলকাতা চলে যান। আবার চাপের মুখে মাফও চান।

প্রথম কথা হলো, সাকিব শুক্রবার মাঠে যেটা করেছেন, সেটা যে কেউ করলেই অপরাধ। তবে সাকিবের জন্য এটা বিশেষ অপরাধ। কারণ সাকিব এখন বাংলাদেশের নেতা, সেরা পারফরমার। তিনি যা করবেন, সবাই তা অনুসরণ করবে। সাকিব যেমন ক্ষমা চাইতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার মতো অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে এমনটা মোটেও কাম্য নয়।‘ আসলেই সাকিবের যে অভিজ্ঞতা এবং যে বয়স, তাতে এসব আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছে, এটা সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। এ নিয়ে লেখালেখিও কম হয়নি। ম্যাচ পাতানো, আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্ব শুনি নিয়মিত ঘটনা। আবাহনীর বিরুদ্ধে নাকি কোনো এলবিডব্লিউ হয় না। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের শেকড়টা শুকিয়ে যাবে, পাইপলাইন বন্ধ হয়ে যাবে। সাকিব যদি সত্যি সত্যি ক্রিকেটকে ভালোবাসেন, ঘরোয়া ক্রিকেটকে বাঁচাতে চান; তাহলে সবাইকে আলোচনা করে একসাথে আওয়াজ তুলতে হবে। কিন্তু মাঠে উইকেটে লাথি মেরে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।

সাকিব আল হাসান এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটের, বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। ঠিকমত ক্যারিয়ার শেষ করলে তার সুযোগ আছে অন্তত পরিসংখ্যানে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার। কিন্তু সাকিব ক্রিকেট খেলাটা ভালো শিখলেও ক্রিকেট চেতনাটা ধারণ করতে পারেননি। ক্রিকেট মানে শুধু খেলা নয়। পারফরম্যান্স, আচার-আচরণ সব মিলিয়েই ক্রিকেট। কেউ যদি খারাপ কিছু করে, এমনকি খেলার বাইরে হলেও, আমরা বলি, ‘ইটস নট ক্রিকেট’। তার মানে ক্রিকেট সভ্যতা, ভদ্রতা, শুভ্রতার চূড়ান্ত রূপ। আজ যারা সাকিবের লাথিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলছেন, তাদের একটু বলি, সাকিব যখন আবাহনীতে খেলেছেন, তখনও তো নিশ্চয়ই আবাহনী এসব অপকর্ম করেছে, সাকিব কি প্রতিবাদ করেছেন। সাকিবের এত প্রিয় আইপিএল, সেখানে তো শুনি নিয়মিতই ম্যাচ পাতানো হয়। সাকিব কি প্রতিবাদ করেছেন।

সাকিবের এই বারবার অপরাধ করার জন্য আমি তার অন্ধ অনুরাগীদেরও দায় দিতে চাই। সাকিব যাই করেন, দেখেন তার সমর্থকরা তো তার পক্ষেই আছে। সাকিব যখন জুয়ারির সাথে দিনের পর দিন কথা বলে আইসিসির নিষেধাজ্ঞা পান, তখন তার ভক্তরা যদি বলতো, সাকিব তুমি যা করেছো, তা অন্যায়, আমাদের কষ্ট দিয়েছে। তাহলে হয়তো সাকিব পরের অন্যায়টি করার আগে ভাবতেন। কিন্তু সাকিবের ভক্তরা বললেন, সাকিব তো শুধু জুয়ারির সাথে কথা বলেছে, টাকা তো নেয়নি। এটা এমন কোনো অপরাধ নয়। অথচ বাংলাদেশ না হয়ে অস্ট্রেলিয়া হলে আইসিসির পরে নিজেদের বোর্ড আরো শাস্তি দিতো। কারণ জুয়ারির সাথে যোগাযোগ রেখে সাকিব বাংলাদেশের মুখে চুনকালি মেখেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে লাথি মেরে উইকেট ভেঙে ফেলার মত নৈতিক জোর কি সাকিবের আছে? সাকিব যখন বাংলাদেশের হয়ে না খেলে আইপিএল খেলতে গেলেন, আমি ভেবেছি, এবার বুঝি তার ভক্তরা তার পাশে থাকবে না। কিন্তু বিস্ময়ের পক্ষে দেখলাম বাংলাদেশের হয়ে না খেলে সাকিবের আইপিএল খেলতে যাওয়ার পক্ষে হাজারটা যুক্তি। এমনকি সাকিবও এত যুক্তি জানতেন কিনা সন্দেহ। শুক্রবার মাঠে সাকিবের কাণ্ড দেখার পর ভেবেছিলাম, এবার বুঝি ভক্তরা সাকিবকে বোঝাবেন। কিন্তু সাকিবের এই লাথি কতটা ভালো, কতটা ন্যায্য; তার পক্ষে যুক্তির পাহাড়। সাকিব নিজে ক্ষমা চাইলেও তার ভক্তকূল এই অপরাধকে মহিমান্বিত করতে উঠে পরে লেগেছেন। এখন ধরুন, মানলাম সাকিব লাথি মেরে খুব ভালো কাজ করেছেন। এখন থেকে যদি উঠতি সব খেলোয়াড়, যাদের বয়স কম, রক্ত গরম; তারাও যদি সাকিবের মত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকে; তাহলে মাঠে তো আর খেলা হবে না। আপনারাই বলুন, সাকিবকে কি উঠতি ক্রিকেটারদের রোল মডেল মানা উচিত?

সব বাবা-মাই তার সন্তানকে ভালোবাসেন। অনেক বাবা-মা সন্তানের অপরাধ আড়াল করেন। কিন্তু এমনটা করতে করতে একদিন সেই সন্তান বড় অপরাধী বা দানব হয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষ যাতে ভুল না করে, সে জন্য তার ভুলটা ধরিয়ে দিতে হবে। ভালোবাসার মানুষের সব অপরাধকে যুক্তির আড়ালে জাস্টিফাই করলে তিনি দানব হয়ে যান। যেমনটি হয়েছেন সাকিব আল হাসান। একই সঙ্গে তিনি দেশের সেরা পারফরমার, একই সঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিতও। সব বাবামাই চাইবেন, তার সন্তান সাকিবের মত পারফরমার হোক। কিন্তু কোনো অভিভাবকই চাইবেন না, তার সন্তান সাকিবের মত মানুষ হোক।

লেখক: প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর