জেট ফুয়েলের উচ্চ মূল্য ও দেশীয় এয়ারলাইন্সের অবস্থান!

, যুক্তিতর্ক

মো. কামরুল ইসলাম | 2023-08-28 01:40:40

বিশ্বে করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরগুলোর কথা আর নাই বা উল্লেখ করা হলো। কারণ একটাই কয়টা সেক্টরের কথা উল্লেখ করা যাবে? দূর্যোগকালীন সময়ে একটা বিষয় উপলব্ধি করার ব্যাপার আছে। একটি সেক্টর ব্যবসাকে প্রাধান্য না দিয়ে পাশে থেকে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অন্য সেক্টরকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভবিষ্যত ব্যবসাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনার পণ্যের ব্যবহারকারীকে টিকিয়ে রাখতে হবে আপনারই। কিন্তু বাংলাদেশ এভিয়েশন সেক্টরের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরন দেখছি প্রতিনিয়ত।

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে আট মাসে সাতবার এভিয়েশন জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের এয়ারলাইন্স ব্যবসাকে অস্থির করে তুলছে। জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশ এভিয়েশনের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে তুলবে। জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি বিদেশি এয়ারলাইন্স এর সাথে দেশীয় এয়ারলাইন্সের প্রতিযোগিতা কঠিন করে তুলবে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ার বিদেশি এয়ারলাইন্স এর দখলে চলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে দেশের এভিয়েশনের ক্ষতি সাধিত হবে, দেশের পরযটন বিপরযস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর সাথে সংশ্লিষ্ট লাখো কর্মীবাহিনী, সাথে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী।     

মহামারিতে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টর হচ্ছে বিশ্ব এভিয়েশন। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ এভিয়েশনে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে যখন সারাবিশ্বের আকাশ পথ সংকুচিত হয়ে আসছিলো, ঠিক তখন থেকেই বাংলাদেশ এভিয়েশনের অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছিল। প্রথমে আন্তর্জাতিক রুটগুলো, পরবর্তিতে অভ্যন্তরীণ সকল রুট বন্ধ হয়ে এক দূর্বিসহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে এয়ারলাইন্সগুলোর পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। গত বছর জুন থেকে ধীরে চলো নীতিতে এগিয়ে স্বল্প সংখ্যক অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছিলো, সাথে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছিলো, এমনকি প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটকে কার্গো ফ্লাইট হিসেবে চালিয়ে কিছু রেভেনিউ অর্জন করার সুযোগ করে দিয়েছিলো। এয়ারলাইন্সগুলোকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখবার প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত ছিলো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের।  

একটি এয়ারলাইন্স এর কোনো রুটে ফ্লাইট পরিচালনার বিভিন্ন খরচের মধ্যে ফুয়েল খরচ প্রায় শতকরা ৪০ভাগ। করোনা মহামারিতে জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ দেশীয় বিভিন্ন এয়ারলাইন্স টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। সরকারের সহযোগিতা চাচ্ছে। বিভিন্ন চার্জ মওকুফের জন্য অনুরোধ অব্যাহত আছে, সেখানে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এয়ারলাইন্সগুলোর টিকে থাকার যুদ্ধকে আরো বেশী কঠিন করে তুলছে। বর্তমান অবস্থায় গত আট মাসে পদ্মা অয়েল কোম্পানী প্রায় ৩৭ শতাংশ জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে, যা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মনোপলি বিজনেস করছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘পদ্মা অয়েল কোম্পানী’।

দেশের এভিয়েশনকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবসার মনোভাব না নিয়ে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। সর্বশেষ ৭ জুন ২০২১ তারিখে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করে নির্দেশনা জারি করেছে পদ্মা অয়েল। যার কারযকর তারিখ ৮ জুন ২০২১। স্বল্প সময়ের নোটিসে মূল্য পরিবর্তন করে তা আবার কারযকরও শুরু হয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপরে এয়ারলাইন অপারেটরগুলোর সাথে কোনো ধরনের আলাপ আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছে না পদ্মা অয়েল কোম্পানী।

প্রত্যেকটি দেশ যেখানে দেশীয় এয়ারলাইন্সকে টিকেয়ে রাখার জন্য জেট ফুয়েলের মূল্যকে যৌক্তিক হারে নির্ধারণ করে থাকে সেখানে বাংলাদেশে প্রতি মাসেই জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করে আকাশপথের চলাচলকে কঠিন করে তুলছে। উদাহরন হিসেবে, ১২ জুন ২০২১ এর মতে, প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ০.৪৬৮ ইউএসডি, ওমান, সৌদি আরবে ০.৪৭৩ ইউএসডি, মায়ানমারে ০.৪৬২ ইউএসডি, থাইল্যান্ডে ০.৪৫৯ ইউএসডি। সেখানে বাংলাদেশে ০.৫৯ ইউএসডি আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য। অন্যান্য দেশের তুলনায় গড়ে প্রায় ১৪% বেশী মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট গুলোর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এর এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলাচল করছে। এতে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা বাংলাদেশি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশি নাগরিকদের চলাচলের জন্য স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক নির্দেশনা অনুযায়ী আকাশপথে যাত্রী স্বল্পতা বিরাজমান, সেই অবস্থায় জেট ফুয়েলের বৃদ্ধি আরো বেশী সংকটে ফেলবে।

বাংলাদেশি ক্যারিয়ার হিসেবে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটর তুলনায় জেট ফুয়েলে প্রায় ২১% বেশী খরচ বহন করতে হয়। এর পিছনে কি কারন থাকতে পারে? খালি চোখে মনে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী সংখ্যার বৃদ্ধিকে রোধ করাই যেন মূল কারণ। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জেট ফুয়েল মূল্য ৬৩ টাকা প্রতি লিটার আর আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৫০ টাকা প্রতি লিটার। দেশীয় এয়ারলাইন্স, দেশের পরযটন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে এগিয়ে নিতে যেখানে এয়ারলাইন্সকে ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন সেখানে জেট ফুয়েলে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হচ্ছে বিমান পরিবহন সংস্থাকে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড জেট ফুয়েল সরবরাহ করে থাকে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার বিদ্যমান রয়েছে সমগ্র ভারতে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতি লিটারে বিভিন্ন ধরনের জেট ফুয়েলের মূল্য নির্ধারিত আছে- ১২ জুন ২০২১ এর হিসেবে চেন্নাইতে প্রায় ০.৬৯ ইউএসডি, কলকাতায় প্রায় ০.৭৪ ইউএসডি, মুম্বাইতে প্রায় ০.৬৮ ইউএসডি ও নিউ দিল্লিতে প্রায় ০.৭০ ইউএসডি। গড়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় ০.৭০ ইউএসডি প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য। সেখানে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে ডলারের হিসেবে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য প্রায় ০.৭৪ ইউএসডি। দেশের এভিয়েশনকে বাচিয়ে রাখতে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড। 

জেট ফুয়েলের মূল্য যেমন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন নির্ধারণ করে তেমনি ডিজেল, কেরোসিন. অকটেন, পেট্রোল, এলপি গ্যাস ও ম্যারিন ফুয়েল ইত্যাদির মূল্যও নির্ধারণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর ওয়েবসাইটে উল্লেখিত ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোল ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল সর্বশেষ দাম নির্ধারন করা হয়েছিলো, এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারন হয়েছিলো ২১ জুলাই ২০২০ এমনকি মেরিন ফুয়েল এর দাম নির্ধারন করেছিলো ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে। অথচ করোনাকালীন সময়ে জেট ফুয়েলের মূল্য সেপ্টেম্বর ২০২০ এর পরই নির্ধারন হয়েছে সাতবার (দি ডেইলি স্টার, জুন ১০, ২০২১ প্রকাশিত) তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

জেট ফুয়েলের বৃদ্ধি সরাসরি যাত্রীদের ভাড়ার উপর প্রভাব পড়ে। তেলের দাম বাড়লে যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যাত্রী সাধারন। ভাড়া বৃদ্ধির ফলে যাত্রী স্বল্পতা দেখা দিতে পারে এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এয়ারলাইন্সগুলো। সাথে যাত্রী প্রতি বিভিন্ন ট্যাক্স থেকে অর্জিত আয় থেকে বঞ্চিত হবে সরকার।

করোনা মহামারিতে ব্যবসার মনোভাব পরিহার করে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি না করে এভিয়েশন সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখতে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। নতুবা আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর সাথে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ, এভিয়েশন মার্কেটের শেয়ার চলে যাবে বিদেশি এয়ারলাইন্স গুলোর কাছে।            

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

এ সম্পর্কিত আরও খবর