নো মিনস নো!

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 17:03:19

পরীমনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় নায়িকা। ইদানীয় সিনেমা দেখা হয় না বলে পরীমনির কোনো সিনেমাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে পত্রপত্রিকায় তার ছবি দেখেছি। অভিনয় কেমন করেন জানি না, তবে নায়িকা হওয়ার মতই সুন্দরী। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ থাকলে পরীমনি নিশ্চয়ই আরও নাম করতে পারতেন। তবে হঠাৎ করেই পরীমনি দেশজুড়ে আলোচনায়।

পরীমনিকে ধন্যবাদ। চারদিন পর হলেও তিনি সত্যটা সামনে এনেছেন। সাহস করে সত্যটা বলেছেন। বিচার চেয়েছেন। বিচার হবে কি হবে না জানি না। তবে পরীমনির সাথে যা হয়েছে, তা গুরুতর অপরাধ। সমাজের উঁচুতলার এইসব অপরাধীর বিচার হতেই হবে। টাকার জোরে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, নারীকে পণ্য মনে করে; নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। আমাদের দেশে নারীরা কতটা অনিরাপদ, পরীমনির ঘটনায় তা আবারও প্রমাণ হয়েছে। ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার পর পরীমনি কিন্তু আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী যা যা করা দরকার, সবই করেছেন। ঘটনার পরপর থানায় গেছেন, হাসপাতালে গেছেন, শিল্পী সমিতিকে জানিয়েছেন, পরিচালক সমিতিকে জানিয়েছেন। সবাই বিস্তারিত জেনে দেখছি বলে চুপ হয়ে গেছে। দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোথাও বিচার না পেয়ে পরীমনি অবশেষে বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ফেসবুক। আর বিচার চেয়েছেন শেষ ভরসা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। পরীমনি তার পারিবারিক বন্ধুর সাথে আশুলিয়া এলাকায় অবস্থিত ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়েছিলেন। সেখানে উত্তরা ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসির ইউ মাহমুদ তাকে জোর করে মদ খাওয়াতে চেয়েছেন। কফি এবং কোকের সাথে অন্য কিছু মিশিয়ে খাওয়াতে চেয়েছেন। খেতে না চাওয়ায় তার মুখে জোর করে মদ ঢেলে দিয়েছেন। অশ্লীল গালাগাল করেছেন। তার গায়ে হাত তুলেছেন। সবগুলো ঘটনাই প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। আইনের শাসন আছে, এমন একটি সমাজে এই ঘটনা ঘটার সাথে সাথে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার কথা। গ্রেফতার তো দূরের কথা, পরীমনি কোথাও আশ্বাসও পাননি। সবাই ঘটনা চেপে যেতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না। তবে ফেসবুকে পরীমনির স্ট্যাটাস এবং পরে সাংবাদিকদের সাথে তার কথা বলার পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। আশা করা যায়, অভিযুক্তরা এবার ধরা পড়বে। তবে ধর্ষণচেষ্টার বিচার চাইতে হলেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে হবে, এটা কোনোভাবেই আইনের শাসনের ধারণার সাথে যায় না। আরেকটা প্রবণতা আমরা ইদানীং দেখি। অনেক অপরাধীই প্রভাবশালী কারো সাথে তার পরিচয় বা সম্পর্কের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। পরীমনির ঘটনায়ও অভিযুক্ত নাসির ইউ মাহমুদ নিজেকে আইজি বেনজির আহমেদের পরিচিত বলে দাবি করেছেন। তার ফেসবুকের কাভারেও আইজির সাথে তার ছবি আছে। আইজির সাথে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের অনেক মানুষের পরিচয় আছে, সামাজিক অনুষ্ঠানে নিশ্চয়ই তার সাথে অনেকে ছবিও তোলেন। কিন্তু আইজির সাথে পরিচয় থাকা বা ছবি থাকা নিশ্চয়ই কাউকে অপরাধের লাইসেন্স দেয় না। নাসির ইউ মাহমুদ যখন আইজির সাথে ছবি তুলেছেন, তখন তো আর তিনি অপরাধটি করেননি, আইজিও নিশ্চয়ই জানতেন না নাসির পরে পরীমনিকে ধর্ষণের চেষ্টা করবে। তাই আইজির সাথে অপরাধীর ছবি আছে, এ কারণে কাউকে হেয় করা যেমন সঙ্গত নয়, তেমনি এই যুক্তিতে যেন কেউ পার না পায়। এরই মধ্যে পুলিশ মূল অভিযুক্ত নাসিরসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। প্রমাণিত হলো আইজির সাথে পরিচয় বা ছবি থাকলেও অপরাধীর পার পাওয়ার সুযোগ নেই।

তবে পরীমনির ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো বাংলাদেশের নারীরা কতটা অনিরাপদ। বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন চিত্রনায়িকাকে তার সাথে ঘটা অপরাধের বিচার চাইতে চারদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইতে হয়েছে। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পরীমনি বলেছেন, চারদিন তিনি একজন সাধারণ নারী হিসেবে বিচার চেয়েছেন। না পেয়ে পরীমনি হিসেবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, এই ক্ষেত্রে একজন সাধারণ নারী কোথায় যাবে? উত্তরও তিনি দিয়েছেন, থানায় যাবে এবং তিনিও গিয়েছেন। কিন্তু থানায় বিচারের বদলে দমিয়ে রাখা হয়েছে। আচ্ছা ধরুন, পরীমনি নয়, ঘটনাটি কোনো সাধারণ নারী হলে তিনি কীভাবে বিচার পেতেন? এমনিতেই বাংলাদেশের নারীরা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা সামাজিক হেনস্থার ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা লুকিয়ে রাখতে চান। অনেক ঘটনা স্থানীয়ভাবে মিটিয়ে ফেলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দিয়ে বিচার করা হয়। সবমিলিয়ে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার অতি সামান্যই আইনের কাছে আসে। কিন্তু অনেক সাহস নিয়ে যারা আইনের কাছে আসে, তারাও যখন আইনের কোনো সুরক্ষা পায় না, তখন ধর্ষকরা আরও সাহস পায়। এই ঘটনায় অভিযুক্তদের তো বিচারের আওতায় আনতেই হবে। কিন্তু পরীমনি রাতে বনানী থানায় যাওয়ার পরও যে পুলিশ সদস্য তার অভিযোগ আমলে নিলেন না, বিচারের আওতায় আানতে হবে তাকেও।

আমাদের আরেকটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা আছে- ভিকটিম ব্লেমিং। অপরাধীকে বাঁচাতে ভিকটিমকেই নানাভাবে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করি। মেয়েটি ওখানে গেল কেন, অমন পোশাক পরলো কেন, অমন করে হাসলো কেন, তেমন করে তাকালো কেন? খলের কখনো ছলের অভাব হয় না। পরীমনির ঘটনায়ও ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধুর সাথে রাত ১২টায় ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়াটাই যেন পরীমনির অপরাধ। কারো কারো কথায় মনে হচ্ছে, সিনেমার নায়িকাদের সাথে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত চিত্রনায়িকা পারিবারিক বন্ধুর সাথে রাজধানীর একটি সুরক্ষিত ক্লাবে গিয়েও নিরাপদ নন? তাকে দেখলেই নাসিরদের মত মাতালরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে? প্লিজ আপনারা আগে নিজেদের মন পরিষ্কার করুন। নিজের মনের নোংরা ভাবনা সমাজের ওপর চাপাবেন না। একজন পুরুষের যেমন, একজন নারীরও যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাওয়ার অধিকার আছে। আর চিত্রনায়িকা মানেই আপনার ভোগের বস্তু নয়। নারী হোক আর পুরুষ, কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কিছু করা যাবে না। একজন পেশাদার যৌনকর্মীরও না করার অধিকার আছে। এমনকি আপনার স্ত্রীরও না করার অধিকার আছে। একাডেমিক সার্টিফিকেট বা পোশাক আশাক আপনাকে সভ্য বা আধুনিক করবে না। আপনাকে চিন্তায় সভ্য হতে হবে। আপনাকে বুঝতেই হবে ‘নো মিনস নো’।

লেখক: প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর