জি-৭, করোনা ও চীন প্রসঙ্গ

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-27 19:18:28

বেশ আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন। ব্রিটেনের রানীর সঙ্গে চা খাওয়া হলো আর ফার্স্ট লেডিদের বাহারি পোশাকের ফ্যাশন শো দেখতে পেলো বিশ্ববাসী।

কিন্তু জাতীয় স্বার্থের বাইরে এসে বিশ্বের সার্বজনীন কল্যাণে উদারতা দেখাতে পারেনি জোট। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিষয়টিই জি-৭ জোটের মূল লক্ষ্য। জিনজিয়াং এবং হংকং ইস্যুতেও বিবৃতি দিয়েছে জি-৭ গোষ্ঠী, যার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে চীন। শীর্ষ সম্মেলনে প্রাধান্য পেয়েছে চীনকে দমনের এজেন্ডা।

অথচ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর জোট জি-৭ সম্মেলন ছিল বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। বৈশ্বিক করোনা মহামারিকালে নেতৃস্থানীয় বিশ্বশক্তিসমূহের ভূমিকার প্রতি সবার মনোযোগ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এমনই পটভূমিতে জি-৭-এর মঞ্চ থেকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জোরালো বার্তাও দিয়ে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।

বিশ্বের অনুন্নত দেশের মানুষের কাছে করোনার প্রতিষেধক পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১০০ কোটি ডোজ়ের ব্যবস্থা করবে জি-৭। এর মধ্যে শুধুমাত্র ৫০ কোটি ডোজ় দেবে যুক্তরাষ্ট্র একাই। বৃটেন আপাতত ১০ কোটি ডোজ় দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। জি-৭ গোষ্ঠীর অন্য দেশগুলো বাকি ডোজ়ের ব্যবস্থা করবে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনের টিকাকরণ প্রক্রিয়া খুবই সাফল্য পেয়েছে। তারই ফল হিসেবে আমরা আমাদের দেশের অতিরিক্ত প্রতিষেধক এমন দেশগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে চাই, যারা এখনও পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই অন্যতম অস্ত্র জোগাড় করে উঠতে পারেনি।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছিলেন, ‘এটা আসলে মানবতার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা। আমাদের শুধু দেখতে হবে কত বেশি সংখ্যক প্রাণ আমরা বাঁচাতে পারি।’

বাস্তবে শীর্ষ সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে এসেছে চীন ও রাশিয়াকে হটানোর বিষয়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও বিশ্ব অর্থনীতিকে নিজেদের কব্জায় রাখার দিকেই ছিল জি-৭ গোষ্ঠীবদ্ধ নেতাদের নজর।

জি-৭ এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো ‘গ্রুপ অব সেভেন’ বা সাতটি দেশের জোট। বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির অধিকারী এই সাতটি দেশ হলো: কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই জোটের একটি অংশ। রাশিয়া ১৯৯৮ সালে এই জোটে যোগ দিলে এর নাম হয়েছিল জি-৮। কিন্তু ক্রিমিয়া দখল করার কারণে ২০১৪ সালে জোট থেকে রাশিয়া বাদ পড়ে।

চীন বর্তমান বিশ্বে একটি বড় অর্থনীতি ও বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও কখনও জি-৭ জোটের সদস্য ছিল না। কারণ কোনও দেশে মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম থাকলে দেশটিকে জোটভুক্ত করা হয় না। ভারতকেও যে কারণে জি-৭ এর সদস্য করা হয়নি।

সাধারণত বৈশ্বিক ইস্যু, যেমন সংঘাত, শরণার্থী, মহামারি ইত্যাদি গুরুত্ব পায় শীর্ষ বৈঠকে। করোনা যখন বিশ্বের বিপদ, তখন বিশ্ব নেতারা এ বিষয়ে তৎপর হবেন, এটাই কাম্য। তদুপরি ভ্যাকসিন রাজনীতি, ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের উগ্র থাবার কবল থেকেও বিশ্ববাসীকে বাঁচানোর দায়িত্ব বিশ্ব নেতাদের রয়েছে। ‘টিকা শুধু ধনীদের’, এমন পরিস্থিতিতে জি-৭ আরও উদ্যোগী ভূমিকা আশা করেছিল বিশ্ববাসী।

তবে, মনে করা হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা ক্রমশ করোনার কবল থেকে মুক্তি পাওয়ায় জি-৭ নেতাদের এজেন্ডায় বিষয়টি মূল গুরুত্ব পায়নি। কারণ ভারত ও বিশ্বের আরও কিছু দেশে করোনার প্রকোপ তীব্রতর হলেও উন্নত দেশের পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক দেশ সম্পূর্ণ টিকাকরণের শেষ পর্যায়ে। কোথাও কোথাও মৃত্যু ও আক্রান্তের হার দ্রুত কমছে।

এমন পরিস্থিতিতে ধাপে ধাপে করোনা-বিধি শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটেন। গৃহীত হয়েছে ‘স্বাধীনতার রোডম্যাপ’। গত কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনামাফিক একটু একটু করে নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। ঠিক ছিল, ২১ জুন সম্পূর্ণ ভাবে লকডাউন তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ডেল্টা স্ট্রেনের বাড়বাড়ন্তে এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হল ‘স্বাধীনতা উদযাপন’। যদিও বাকি ইউরোপ নির্ভীক।

ফ্রান্সে যেমন সংক্রমণ কমতেই রাতের কারফিউ তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্যাফে, রেস্তরাঁর ভিতরে বসে খাওয়া যাচ্ছে। তবে স্বাভাবিক সময়ে যে সংখ্যক লোক একসঙ্গে বসতে পারতেন, সংখ্যাটা তার অর্ধেক করা হয়েছে। অতিপ্রয়োজনীয় নয়, এমন দোকানও খুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি জিম, সিনেমা হল সব। তবে মাস্ক পরা এখনও (৩০ জুন পর্যন্ত) বাধ্যতামূলক।

জার্মানিতে সেই পাঠও চুকেছে। বার্লিনের মতো শহরাঞ্চলেও মাস্ক পরতে হচ্ছে না কাউকে। তবে ১৬টি প্রদেশের প্রতিটিতে আঞ্চলিক প্রশাসন নিজেদের মতো নিয়ম জারি করেছে। যাঁদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনও কড়াকড়ি নেই। তবে জমায়েতের ক্ষেত্রে নিয়ম, তিনটি পরিবারের সর্বোচ্চ ছ’জন এক জায়গায় জড়ো হতে পারেন।

ইতালি, স্পেনও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায়। তবে ভিড় করতে দেওয়া হচ্ছে না কোথাওই।

এদিকে, করোনা-বিধির প্রতিবাদে প্যারিসে স্ট্রিট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আমেরিকান ফিল্মের নামে প্রতিবাদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘প্রোজেক্ট এক্স’। কয়েকশো মাস্কহীন লোক সেখানে জড়ো হন। তাঁরা পুলিশের ভ্যান লক্ষ্য করে ভাঙা বোতল ছোড়েন। গাড়ি ভাঙচুর করেন। শেষে পরিস্থিতি সামলাতে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়েছে পুলিশকে। লুভর মিউজিয়ামের কাছে সেন নদীর তীরে অন্য একটি জমায়েত হয়েছিল। সেটি অবশ্য কোনও প্রতিবাদ নয়। মধ্যরাতে সেই পার্টিও ভেঙে দেয় পুলিশ। শহরের পাবগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। অল্পবয়সীদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। প্রশাসনিক কর্তারাও বলছেন, ‘জানি দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকা কষ্টকর। কিন্তু ভাইরাস এখনও যায়নি।’

সম্প্রতি একই কথা বলতে শোনা গিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ শাখার প্রধান মাইক রায়ানের মুখে। তাঁর কথায়, ‘যে ভাবে ফিল্ম ফেস্টিভাল, স্পোর্টস টুর্নামেন্ট চলছে, মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে লোক অন্য প্রান্তে যাচ্ছেন, তাতে বিপদ আসন্ন। এরই মধ্যে ফরাসি ওপেনের শেষ হয়েছে। সামনের মাসেই উইম্বলডন। ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ চলছে। এই সবই যে ভয়ের কারণ হওয়ার যথেষ্ট, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন রায়ান।

পরিস্থিতি এখনও বিপদমুক্ত না হলেও ইউরোপ করোনার মূল আঘাত সামলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। সকলের টিকাকরণ সম্পন্ন হওয়ায় মৃত্যু ও আক্রান্তের হার যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েছে নাগরিকদের আত্মবিশ্বাস ও সাহস।

পক্ষান্তরে, গরির দেশগুলো, যেখানে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে চলছে অনিশ্চয়তার দোলাচল, যেখানে বিপদ এখনও মারাত্মক আকারেই রয়েছে। উন্নত দেশ থেকে করোনা ঝুঁকি অনুন্নত বিশ্বে সরে যাওয়ায় ধনী দেশগুলো জোট জি-৭ এ বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা নেয়নি। বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণের আলোকে তাঁরা নিয়েছেন নিজের জাতীয় স্বার্থের এজেন্ডা এবং চীনের উত্থান বিরোধী সম্মিলিত অবস্থান।

লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম 

এ সম্পর্কিত আরও খবর