স্যালুট অল টিচার্স!

, যুক্তিতর্ক

মো. কামরুল ইসলাম | 2023-08-31 07:14:56

আপনাদের ১৭ মার্চ ২০২০ এর কথা মনে আছে। যেদিন থেকে কয়েকদিনের জন্য স্কুল, কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। কারণ একটাই মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি। সেই ছুটি অনির্দিষ্ট কালের আবরণে ঢাকা পড়েছে। সরকারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার অবস্থা তৈরি হয়নি এখনো বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে একটা সময় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শহরকেন্দ্রিক ছিলো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ শহর থেকে উপজেলায়, সেখান থেকে মহস্বলে ছড়িয়ে পড়েছে। বলা যায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২০ সালের এসএসসি, এইচএসসি এমনকি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও বাতিল করতে হয়েছে। সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাসে অটো প্রমোশন দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে ২০২১ সালের পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করেছে যা সত্যিই দুঃখজনক। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। একজন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনেক প্রতীক্ষার ফসল। কিন্তু করোনার কারণে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি ও গ্রিন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনলাইনে সম্পন্ন হয়েছে।

করোনাকালে আমাদের শিক্ষক সমাজ কেমন আছেন? আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রসার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও মাসিক বেতন, উৎসব বোনাসসহ প্রায় সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু সারা দেশের সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ প্রকৃতপক্ষে কেমন আছেন? অনির্দিষ্টকালের বন্ধের মধ্যে শিক্ষকদেরও খেতে হয়, বাসাভাড়া দিতে হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে হয়, ঈদ আনন্দ তো উনাদেরও থাকার কথা, পুজা-পার্বন, বড়দিন সবই তো উপস্থিত আছে, কোভিড থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করতে হয়, চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের ফি দিতে হয়, হাসপাতালে যেতে হয়, ঔষধ কেনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এত্তোসব চাওয়ার মধ্যে প্রয়োজন আয়ের নিশ্চয়তা। কিন্তু আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের সেই আয়ের নিশ্চয়তা কি ছিলো এই করোনাকালীন সময়ে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় শিক্ষকদের জন্য কিছু ইনসেনটিভ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। টানা ছুটির কারণে সরাদেশের কিন্ডারগার্টেনসহ প্রি-প্রাইমারী স্কুলগুলো প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল শিক্ষকবৃন্দ যারপরনাই কষ্টে দিনানিপাত করছেন। সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। এসব কিন্ডারগার্টেন ও প্রি-প্রাইমারী স্কুলগুলো পরিচালনা করার জন্য যেসকল বিনিয়োগকারী ছিলেন, তারাও আজ নিঃস্ব প্রায়!

যেসকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা স্বচ্ছল ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ছিলো, সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকবৃন্দ করোনার শুরু থেকেই অর্ধেক বেতনে অন-লাইনে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতিটি স্কুলে, প্রতিটি ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। যথারীতি ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক বেতনও সেভাবে কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে না, ফলস্বরূপ শিক্ষকরাও বেতন পুরোপুরি পাচ্ছেন না। মহামারী করোনার কারণে আয়ের উপায়গুলোও সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে অভিভাবক সেই ভাবে উপার্জন করতে না পারার কারণে ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।     

করোনার থাবা শিক্ষা ব্যবস্থার যে নানা ত্রুটি তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। আর এসব ত্রুটি আমাদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনলাইনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিশু-কিশোর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো চালিয়ে নিতে পারছে কিন্তু আমাদের গ্রাম বাংলা সেইভাবে কি পেরে উঠছে? সব ছাত্রছাত্রীদের কি মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার সামর্থ্য ছিলো কিংবা আছে? যদি না থাকে কোটি প্রাণ কিভাবে দেশের ভবিষ্যৎ কর্নধার হবে? ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে? একটি জেনারেশন কি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে? শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কো-কারিকুলাম, খেলাধূলায় পারঙ্গমতার কি হবে? মানসিক বিকাশ কিভাবে গড়ে উঠবে? কিভাবে স্কুল কেন্দ্রিক ফুটবল, ক্রিকেট খেলোয়ার তৈরি হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বয়স ভিত্তিক খেলোয়ার তৈরিতে বিরাট বাধা হয়ে আছে।

শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নেয়ার জন্য প্রয়োজন ভালো মানের অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার তেমনি প্রয়োজন ছাত্র-ছাত্রীদের। দেশে এখনেও রয়েছে অর্থকষ্টের নানা গল্প- কষ্ট। শুধু মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ কিনলেই হবে না সাথে প্রতি মাসের জন্য নির্ধারিত ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ। আয় যেখানে সংকুচিত সেখানে খরচ কি সংকুচিত থাকছে?

অনেক অভিভাবকদের কিছু অযৌক্তিক কথামালাও দেখতে পাই সোশ্যাল মিডিয়ায়। শিক্ষকরা তো অনলাইনে ক্লাস নেন- উনাদের কেনো পূর্ণ বেতন দিতে হবে? আপনাকে ভাবতে হবে অনলাইনে ক্লাস নিলেও শিক্ষকরা আপনার সন্তানের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আপনি অন্যান্য খরচের খাত ঠিক রেখে শিক্ষকদের বেতন দিতে কার্পন্য করছেন। যা কখনই সুচিন্তিত কর্মের ফল নয়।     

শিক্ষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ কারিগর হিসেবে। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষকদের পাশে থাকুন। সন্তানের ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করবে আপনি কিংবা আমি নিই, করবে শিক্ষক। আমার সকল শিক্ষক, আমার সন্তানের সকল শিক্ষকদের প্রতি সম্মান রেখে জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

স্যালুট অল টিচার্স। 

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ই-মেইল- Islam.kamrul.72@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর