রিকশা শ্রমিকদের কেউ নেই!

, যুক্তিতর্ক

সজীব ওয়াফি | 2023-08-31 10:20:21

করোনা মহামারি কাল চলছে। নিম্নবিত্ত প্রতিটি পরিবারই অতিক্রম করছে নানান অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। এর ভিতরেই সরকারপক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত, একেইসঙ্গে ইজিবাইকও নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং যা ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেয়া হবে। বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে হঠাৎ করে এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে বিপাকে পেরেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান শ্রমিকেরা, ভাবতে হচ্ছে রুটি-রুজির পথ।

গত দেড় বছরে করোনাভাইরাস মহামারী ও টানা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমিকশ্রেণী। ক্ষতিগ্রস্ত, কর্মহীন, বেকার ও ছাঁটাই হওয়া এ-সব শ্রমিকদের পাশে সরকার ও মালিকপক্ষ দাঁড়ায়নি; দেয়নি কোন প্রণোদনা। নতুন করে ২.৫ কোটি মানুষসহ অর্ধেকের বেশি মানুষ যখন দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে, সেই সময়ে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে কর্মরত ৫০ লাখ রিকশা, ব্যাটারি রিকশা ও ভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন চালককে বেকার ও কর্মহীন করার বার্তা এলো।

ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক বন্ধের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ। বলতে চেয়েছেন ৭০ ভাগ দুর্ঘটনা এই সকল যানবাহনের জন্য ঘটে এবং বিদ্যুৎ খরচ হয়। সমালোচনার মুখে পরে এর বিপরীতে প্যাডেল চালিত যানবাহন রাখার বিবৃতি দিয়েছেন। 

বাংলাদেশের গলিঘুপচির বাস্তবতায় সত্যিকারের গণপরিবহন হল ব্যাটারি চালিত রিকশা, ইঞ্জিন চালিত ভ্যান, ভটাভটি এইসব। কিন্তু এগুলো নিয়ে কখনোই কোন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। বারবারই দেখা গেছে নিয়ন্ত্রণের নামে গরিব রিকশা চালকদের রিকশা কেড়ে নিয়ে বুলডোজারের নিচে দিয়েছেন আমাদের আইন প্রণেতারা। কিস্তিতে কেনা রিকশা রাস্তার সাথে পিসিয়ে দেয়ার আগে কর্তাদের পায়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, চোখের পানিতেও মন গলেনি। কিস্তির টাকা কিভাবে শোধ করবেন এ বিষয়ে হর্তাকর্তারা বরাবরই নিশ্চুপ।

একজন শহুরে রিকশা বা ভ্যান শ্রমিক দৈনিক গড়ে তিনশত টাকা আয় করেন। গ্রামাঞ্চলে আয়ের পরিমাণ আরো কম। সেই টাকা দিয়ে কোনমতে মানবেতর দিনগুজার হয়, পরিবার পরিজনের মুখে খাবার তুলে দেন। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যয়ও আসে এই শ্রম বিক্রির আয়ে।

মহাসড়ক বাদ দিয়ে দেশের অধিকাংশ রাস্তার জন্য হালকা বাহনগুলো দারুণভাবে উপর্যুক্ত। পাবলিক পরীক্ষার সময়ে দূরের কেন্দ্র যেতে ভ্যান-রিকশা এবং ইজিবাইক ব্যবহার করে মফস্বলের শিক্ষার্থীরা। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণেও ভূমিকা রাখে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলে মেডিকেলে যেতে রিকশা-ভ্যানই এখনো গরিব মানুষের একমাত্র বাহন। মোটকথা যাতায়াত, বিনোদন, শিক্ষা এবং চিকিৎসায় অকল্পনীয় রূপান্তর এনেছে হালকা বাহনগুলো।

প্যাডেল চালিত ভ্যান-রিকশা একদিকে অমানবিক, অন্যদিকে প্যাডেল চালিয়ে আয়ের পরিমাণও নিম্নের কোঠায়। দ্বিতীয়ত প্যাডেল চালিত রিকশায় বর্তমান গতিশীলতা কমে আসবে বহুলাংশে। কিছু একটা হলেই আমাদের আইন প্রণেতারা উন্নত রাষ্ট্রের উদাহরণ টানেন। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলোতে যেখানে ইঞ্জিন চালিত রিকশা যানবাহন হিসেবে স্বীকৃত, তাহলে আমাদের শহরে কেন থাকবে না! রিকশা-ভ্যান বন্ধ করে দিলে বা ব্যাটারি খুলে নিলে এই মানুষগুলো যাবে কোথায়? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার গ্রামে গিয়ে সপরিবারে ভ্যানে চড়বার দৃশ্য প্রচারকারীরা এর ভিতরেই ভুলে গেলেন?

বিগত আট বছর ধরে নকশার আধুনিকায়ন, নীতিমালা প্রণয়ন, ব্যাটারি চালিত রিকশা ও ইজিবাইকসহ যান্ত্রিক যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানসহ তিন দফা দবিতে আন্দোলন করে আসছিলো শ্রমিকরা। সেদিকে তোয়াক্কা না করে বরং বিকল্প ব্যবস্থার আগে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া এরকম গনবিরোধী সিদ্ধান্ত ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। যদি ব্যাটারি চালিত ভ্যান রিকশা বন্ধ করে দিতেই হবে; তবে ব্যাটারি রিকশা যখন বিক্রি হল, যন্ত্রাংশ আমদানি হল, তখন ব্যবস্থা নেয়া হল না কেন?

ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্রেক পদ্ধতি এবং কাঠামোগত দুর্বলতার আধুনিকায়ন না করে রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মত। বাংলাদেশে ভ্যান রিকশার চাহিদা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সত্যি বলতে যারা গনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা গণপরিবহনে চড়েন না। করের আওতায় থাকা এবং দেশীয়ভাবে নির্মিত হালকা যান্ত্রিক বাহনগুলোই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। মহাসড়ক গুলোতেও এই হালকা বাহনগুলো জন্য পার্শ্বরাস্তা থাকাটা অত্যাবশ্যক।

লেখক: সজীব ওয়াফি, রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর