আফগান সংকট: হুমকিতে দক্ষিণ এশিয়া!

, যুক্তিতর্ক

সজীব ওয়াফি | 2023-09-01 17:32:18

প্রায় দুই দশক পর আফগানিস্তানে নিযুক্ত ন্যাটো সেনারা দেশটির দেশটির বাগরামে অবস্থিত বিমানঘাঁটি ত্যাগ করেছে। শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবেই সেনা প্রত্যাহার করলো যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের পর নতুন করে সংঘাতে জড়িয়েছে তালেবান। ন্যাটো সেনাদের আক্রমণ না করতে সতর্ক থাকলেও আফগান সরকারি বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকেরা তাদের লক্ষ্য। এক হাজারেরও বেশি সেনাসদস্য জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাজিকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে রাষ্ট্রটি, আশেপাশের বহু দেশে যার আঁচ লাগতে বাধ্য। হুমকিতে পরেছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া।

কুড়ি বছর আগের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ারে সোজা বিমান ঢুকিয়ে হামলা চালায় আল-কায়দা সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শুরু হয় আমেরিকার যুদ্ধ। সেই সূত্রেই মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে আসে। পতন ঘটে তালেবান শাসনের।

গত শতাব্দীর শেষাংশে শুধুমাত্র মৃত্যু এবং ধ্বংস দেখেছে আফগানিস্তান। ১৯৭৮ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিডিপিএ(পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান) আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। সরকারের অন্তদ্বন্দ্ব এবং বিদ্রোহীদের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কমিউনিস্ট সরকার রক্ষা করতে সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হয়। অতঃপর মার্কিনি অর্থায়নে মুজাহিদ বাহিনীর সোভিয়েত বিরোধী লড়াই চলে ১৯৭৯-৮৯ পর্যন্ত। সোভিয়েত বাহিনী হটাতে ১৯৮৯ সালে উগ্র তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায়। মার্কিন জোটের হাতে পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পৃথিবী দেখেছে তালেবানদের ইসলামি আমিরাতের উগ্র ভয়াল রূপ।

২০০১ সালে কাবুলে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সরকার। প্রতিষ্ঠা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের। জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছিল নিয়মিতই। আফগান নারীরাও প্রথমবারের মত নির্বাচনে প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, ক্রিকেট, ফুটবল এবং অলিম্পিকসহ এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে নারীদের পদচারণা পৌছায়নি।

তালেবান শাসনামলে অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর। ছিল না কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আছে বেসরকারি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্যান্য আর্থিক পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তালেবানরা ধ্বংস করেছে তাদের নানান ঐতিহাসিক স্থাপনা। ধ্বংস করা স্কুল কলেজগুলো আবার নতুন করে দাড়িয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দ্বিতীয়বার তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের বিজয় দেখেছে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেসরকারি হিসাব অনুয়ায়ী ন্যাটোর খরচ হয়েছে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিহত হয়েছে ২ হাজার ৩০০ মার্কিন সেনা, আহত হয়েছে ২০ হাজার ৬৬০ সদস্য। তালেবান নির্মূল করার আগেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আইএস এবং আল-কায়দার সাথে যুদ্ধে মনোযোগী হয় মার্কিন। আফগানে অমনোযোগীতার এই সুযোগে তালেবান নতুন করে পাকিস্তান সীমান্তে পুনরুজ্জীবিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসলো তালেবানদের অর্থ সহায়তা।

তালেবানদের এতদিন শক্ত ঘাঁটি ছিলো দক্ষিণ আফগানিস্তান। ন্যাটো সৈন্যরা আফগান ত্যাগ করতে শুরু করায় এবার তারা উত্তরের দিকেও ছড়িয়ে পরেছে। আফগান সেনারা এলাকা সুরক্ষিত রাখতে পারছে না। একের পর এক বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলার দখল নিচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে পঞ্চাশটির বেশি জেলা আফগান সরকারের হয়েছে হাতছাড়া। তাজিকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত শহর দখলের পাশাপাশি কব্জা করেছে নাহরিন এবং বাখলান-ই-মারকাজি শহর।

অর্থ এবং সেনা শক্তির অপচয় রোধে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ শেষ করে সেনাদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছতে চলেছিলো সমঝোতা আলোচনাও। চুক্তির ফলে তালেবানদের সঙ্গে আফগান রাজনীতিবিদদের আলোচনার দুয়ার খুললেও নারী অধিকার এবং গণতান্ত্রকে ভালো চোখে দেখবে না। তালেবানদের ইসলামি রাষ্ট্র আর আধুনিক গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান ধারনার সমন্বয়ও অসম্ভব। বরং তালেবানদের বর্তমান অবস্থানে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়ে গেছে।

তুরস্ক চেয়ে আসছিল একটি স্থিতিশীল অবস্থা। কিন্তু মার্কিন সমর্থন না পেলে তুর্কিদের টিকে থাকা অসম্ভব। সমর্থন যে পাবে না এটা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কার্যকলাপেই স্পষ্ট। সুতরাং আফগানের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধে তুরস্ক নিজেকে বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। মার্কিন চাচ্ছে পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি করে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণ করবে। দ্বিতীয়ত চীন ও রাশিয়া এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির তুমুল বিরোধীতা করবে। তালেবান প্রশ্নে পাকিস্তানও জানিয়েছে সেখানে তারা সামরিক ঘাঁটি করতে দিবে না।

আপাতদৃষ্টিতে তালেবানদের সাথে পাকিস্তানের সুবিধাজনক অবস্থা দেখলেও এটা নড়বড়ে। আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত ডুরান্ড লাইন অমিমাংসীত তালেবানদের কারনেই। আদর্শগত কারণেও তালেবান পাকিস্তানের তাঁবেদারি করতে চাইবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানে শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে সংঘাত ঘটবে তালেবানদের। কারন বিগত দিনে শিয়া-পশতুনদের সাথে তালেবানীরা নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।

চীনের উইঘুর সম্প্রদায়ও তালেবানি হয়ে উঠবে না তার নিশ্চয়তা নেই। জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে পারে শ্রীলঙ্কা এবং নেপালে। আফগানিস্তান হবে যার তীর্থভূমি। ইতোমধ্যে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আফগান সরকারে ছিলো তারা পালিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। মোটকথা মার্কিনিরা যাদের বন্ধু, তাদের আর শত্রুর প্রয়োজন পরে না। দক্ষিণ এশিয়াকে ঠেলে দিলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি।

তালেবানদের আদর্শ এবং অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তারা ক্ষমতায় আসলে নারী শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটবে, ধ্বংস করে দিবে স্কুল-কলেজগুলো, পুড়িয়ে দিবে লাইব্রেরি। গুড়িয়ে দিবে নতুনে তৈরি হওয়া স্থাপনা, শিল্পসাহিত্য এবং জাদুঘর। গৃহযুদ্ধের এই দামামা পাশের রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় আফগানিস্তানে সম্মিলিত রাজনৈতিক সরকার। এখন দেখা যাক কোন পথে হাটে তালেবান। তাদের হাটার দিক দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে সুরক্ষা বলয় তৈরি নির্ধারণ করবে।

লেখক: সজীব ওয়াফি, রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর