আর কত শ্রমিক প্রাণ দিলে তাদেরকে মানুষ বলবেন?

, যুক্তিতর্ক

ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন | 2023-08-26 00:23:33

বব ডিলন আমেরিকার একজন বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী। তিনি ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পান। তাঁর একটি গান সারা বিশ্বে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। গানটির শিরোনাম হচ্ছে- ‘ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড’। গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন: হাউ ম্যানি রোডস মাস্ট এ ম্যান ওয়াক ডাউন, বিফোর ইউ কল হিম এ ম্যান? ... দ্যা আনসার, মাই ফ্র্যান্ড, ইজ ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড। দ্যা আনসার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড’। বাংলা অনুবাদ: ‘একজন মানুষকে কত রাস্তায় হাঁটতে হবে, আপনি তাকে মানুষ বলার আগে? উত্তরটি, আমার বন্ধু, বাতাসে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরটি বাতাসে প্রবাহিত হচ্ছে [অর্থাৎ, প্রশ্নটির উত্তর খুব কঠিন নয়। উত্তরটি এতটাই দৃশ্যমান যে তা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে]।’

ঠিক তেমনি যদি প্রশ্ন করা হয়:  আর কতজন শ্রমিকের প্রাণ গেলে আপনি তাদেরকে মানুষ বলে বিবেচনা করবেন? কারখানায় কিভাবে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন? কারখানার কাজের পরিবশে কিভাবে শ্রমিক-বান্ধব করবেন? কাজ শেষে শ্রমিক কিভাবে নিরাপদে বাড়িতে ফিরবে? কতজন নারী তার স্বামীকে হারাবে? কতজন স্বামী তার স্ত্রীকে হারাবে? কতজন সন্তান তার মা-বাবকে হারাবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর এতটাই সহজ যে সবাই জানে। এর জন্য বিশেষ্ণ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ একজন মানুষও জানে যে কোনো বহুতল ভবনের সিঁড়িগুলো যদি প্রশস্ত না হয় তাহলে আগুন লাগলে বা জরুরি মুহূর্তে একসাথে বহু মানুষ ভবন থেকে বের হতে পারবে না। অগ্নিকাণ্ডের সময় যদি প্রধান গেইট বন্ধ থাকে তাহলে মানুষ দ্রুত বের হয়ে আসতে পারবে না। কিন্তু, কারখানার মালিক তা বুঝতে পারে না। আসলে বুঝেও তারা বুঝতে চান না। কারণ, সে জানে যে পূর্বেও বহু কারখানায় দুর্যোগ ঘটেছে। দুর্যোগে বহু শ্রমিকে প্রাণ গিয়েছে। কিন্তু, কারখানা মালিকরা কৌশলে জবাবদিহীতা থেকে পালিয়ে বেড়াতে সক্ষম হয়েছে।

সম্প্রতি ৮ জুলাই ২০২১ তারিখে বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের একটি ছয়তলা ভবন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ৫২ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং এবং আহত অবস্থায় ২৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে (দৈনিক যুগান্তর, ১০ জুলাই ২০২১)। দুর্যোগের প্রকৃত কারণ এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি তবে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে কারখানার অব্যস্থাপণা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই মূল কারণ।

কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে অনেকেই ‘দুর্ঘটনা’ বলে সংজ্ঞায়িত করেন। কোনো ঘটনাকে তখনই দুর্ঘটনা বলা যায় যখন সংশ্লিষ্টরা এর জন্য মোটেই প্রস্তত নয়। ক্ষয়ক্ষতি অনুমানের বাইরে থাকে। কিন্তু, কারখানায় আগুন লাগতে পারে, আাগুনে পুড়ে সম্পদের ক্ষতি হতে পারে ও শ্রমিকের মৃত্যু ঘটতে পারে-এগুলি অনুমান করা যায়। কারখানায় বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটা ও প্রাণহানির ঘটনাকে কেবলমাত্র দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করলে এই জটিল ধারণা সম্পর্কে বোঝাপড়ায় ঘাটতি থেকে যাবে। এটি যে একটি কাঠামোগত সমস্যা-সেটি বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরকে স্বীকার করতে হবে। কাঠামোগত বলতে বোঝানো হচ্ছে যে রাষ্ট্রের সুশাসনের যে ব্যবস্থা বা কাঠামোগুলো আছে যেমন-কারখানা আইন, শ্রম আইন ও জাতীয় বিল্ডিং কোড, সেগুলোর দলিলে কি আছে আর বাস্তবে তা কি প্রক্রিয়ায় চর্চিত হচ্ছে। কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝা জরুরি যে চর্চিত প্রক্রিয়ায় কারখানায় শ্রমিকদের জন্য কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, দুর্ঘটনায় সাড়া দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা, নিয়ম ভঙ্গের জন্য কারাখানাগুলো শাস্তি পেয়েছে কিনা, শ্রমিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনি ব্যবস্থা চালু আছে কিনা ও শ্রমিকের জন্য ঝুঁকি বীমা আছে কিনা? এগুলোর ব্যবস্থা যদি কারখানায় অনুপস্থিত থাকে কিংবা এগুলোকে হালকা করে দেখা হয় কিংবা এগুলোর প্রতি উদাসীনতা থাকে-তাহলে বুঝতে হবে কারখানায় আগুন ও আগুনে শ্রমিকের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। বরং, এটি দুর্যোগ বা বিপর্যয় (ডিজাস্টার)।

দুর্যোগ বা ডিজাস্টার তখনি ঘটে যখন ভিকটিমরা আগে থেকেই সম্ভাব্য ‘ভিকটিম’ হিসেবে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গরিব বা নিম্ন-আয়ের লোকেরা দুর্যোগের শিকার হন এবং তাদেরই জানমালে ক্ষতি হয় বেশি। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি শিল্প দুর্যোগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতিপরায়নতাই দুর্যোগগুলোর মূল কারণ। আশুলিয়ায় ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশন নামের এক পোশাক কারখানার অগ্নিকাণ্ডের ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিক নিহত হন। আহত হন কয়েকশ শ্রমিক। নিহত পরিবারের স্বজন এবং আহত শ্রমিকগণ চিকিৎসা ব্যয় ও পুনর্বাসনের জন্য দাবি জানিয়েছেন কিন্তু কর্তৃপক্ষ হতে সন্তোষজনক সাড়া এখনও পাওয়া যায়নি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করছে। তাদের মতে, আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারগুলো এখনও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, কারখানার মালিকপক্ষরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনের হাত তাদেরকে ধরতে পারে না। অন্যদিকে, শ্রমিকেরা গরিব ও অসহায় হওয়ার কারণে কাঠামোগত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিদ্যমান আইনি কাঠামো তাদের হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলেনা। প্রচলিত কথায় আছে যে, ‘ন্যায় বিচার যদি বিলম্বিত হয় তাহলে তা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’

বাংলাদেশে শিল্প বিপর্যয়ের ইতিহাসে সাভারের রানা প্লাজার ধসটি একটি ভয়াবহ ঘটনা ছিল-যেটি আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে গার্মেন্টস মালিকের গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি কিভাবে হাজারো শ্রমিকের জীবন কেড়ে নিতে পারে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ২৪ শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১শ ৩৬ জনের মৃত্যু ঘটে। এই দুর্যোগ ঘটার আগেই বিশেষ্ণগণ ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু, তাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ভবনে অবস্থিত কারখানাগুলোর মালিক শ্রমিকদের কাজে আসতে বলেছে। এটিকেও কোনোভাবেই নিছক দুর্ঘটনা বলা ঠিক হবেনা দুর্যোগ ঘটার পূর্বশর্তগুলো (মালিকের গাফিলতি, কাজের অনিরাপদ পরিবেশ) আগে থেকেই ছিল। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বিদ্যমান আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের পরিণতিই ছিল রানা প্লাজা ভবনের ধস এবং শ্রমিকদের মৃত্যু। প্রশ্ন থেকেই যায়- আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার ক্ষমতা রাখে কে, অনিরাপদ পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য থাকে কে? এগুলো কাঠামোগত সমস্যা। সমস্যাগুলো সমাধান করবে কে? এই সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে: রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের আইন ও সুশাসন যদি শক্তিশালী ও পক্ষপাতহীন থাকে তাহলে বহু অসহায় ও গরীব শ্রমিকের প্রাণ রক্ষা পাবে। অন্যথায়, প্রশ্ন থেকেই যাবে: আর কতজন শ্রমিক প্রাণ দিলে আপনি তাদেরকে মানুষ বলবেন?

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর