করোনায় বিশ্বাসের বির্বতন

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-08-31 00:22:20

বিশ্বাস একটি সমাজ-মনোবৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়। মুক্ত বিশ^কোষ বাংলা উইকিপিডিয়া মতে, বিশ্বাস বলতে সাধারণত পারিপার্শ্বিক বিষয়-বস্তুরাজি ও জগৎ সম্পর্কে কোনো সত্ত্বার স্থায়ী-অস্থায়ী প্রত্যক্ষণকৃত ধারণাগত উপলব্ধি বা জ্ঞান এবং তার নিশ্চয়তার উপর আস্থা বোঝানো হয়। সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্বাস শব্দটি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা আলাদা অর্থ বহন করতে পারে, তাই জ্ঞান, সত্য ইত্যাদির মত বিশ্বাসেরও কোনো একটি সর্বজনসম্মত সংজ্ঞা নেই।

কোনো বিষয় সত্য না মিথ্যা তা বিচার করে - সত্য মনে হলে তা “বিশ্বাস করা” অথবা মিথ্যা মনে হলে অবিশ্বাস করা আর মিথ্যা হবার সম্ভাবনা বেশি মনে হলে সন্দেহ করা হয়। বিশ্বাস মানে হতে পারে আস্থা, ভরসা। বিশ্বাসের দৃঢ়তা (বিশ্বাস যত বেশি সন্দেহ তত কম) খুব বেশি হলে তাকে বলা যায় ভক্তি বা অন্ধবিশ্বাস।

আবার বিশ্বাস মানে হতে পারে আশা বা আশ্বাস বা বিশ্বাস করার ইচ্ছা। বিশ্বাস হতে পারে কোন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ অনুভূতির সচেতন অনুধাবন; বা কোনো তথ্য বোধগম্য হওয়া এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যাচাই করার পর এই বোধের নিশ্চয়তা সম্বন্ধে প্রত্যয় বা প্রতীতি জন্মালে (সত্য বলে স্থায়ী ধারণা) হলে তাকে জ্ঞান বলা যায়। পর্যবেক্ষণের উপর যুক্তির (ও পূর্বলব্ধ জ্ঞানের) সাহায্যে বিচার করে কোন বিষয় সত্য বলে সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে নতুন জ্ঞান জন্মায়। এইভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধ সত্যগুলোকে জুড়ে যে তত্ত্বের জাল বোনা হতে থাকে তাদের বিষয়বস্তুগুলো সামগ্রিকভাবে হলো জ্ঞান আর তাদের গ্রহণযোগ্যতার সচেতন অনুমোদন হলো বিশ্বাস। বিশ্বাসের সঙ্গে মূল্যবোধ ও ভালোমন্দ বিচারও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

বিবর্তন শব্দটি জীববিজ্ঞানের সাথে বেশি সম্পৃক্ত। চার্লস ডারউইনের বির্বতনবাদী মতবাদ সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। অপরদিকে, সমাজবিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা মনে করেন কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, বির্বতনের মধ্য দিয়েই সবকিছু পরিবর্তিত হয়; বিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে বির্বতনবাদী প্রক্রিয়ায়। যুগ যুগ ধরে এই ধারায় অব্যাহত আছে। অপরপক্ষে, আরেকদল এই বির্বতনবাদী ধারার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আছেন। বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার পেছনে অন্ধবিশ্বাসের বিষয়টি জড়িত। যারা অন্ধবিশ্বাসী তারা এই বির্বতনবাদী ধারা মেনে নিতে নারাজ। ফলে কোনো নতুন কিছুর আর্বিভাব বা পরিবর্তনকে তারা সহজে গ্রহণ করেননা বা করতে চাননা। বরং তাদের অন্ধবিশ্বাস বা ধারণার আলোকে নতুন পরিস্থিতি বা বিষয়কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। সে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যদি তাদের অন্ধবিশ্বাসের পক্ষে যায় তাহলে সেটি তারা সঠিক বলে প্রচার করেন, বিপক্ষে গেলে ভ্রান্ত ধারণা প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। করোনাভাইরাস রোগের ক্ষেত্রেও আমরা এই বিষয়টি শুরুতে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু বিশ্বাস বা ধারণা যে পরিবর্তিত হয় সেটি এখন দৃশ্যমান।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) একটি নতুন সংক্রামক রোগ যেটি ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম সনাক্ত হয়। বাংলাদেশে এটি সনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। সে হিসেবে আজ পর্যন্ত অর্থাৎ  দেড় বছরেরও অধিককাল এই রোগটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কোভিড-১৯ আমাদের চিরচেনা জগৎটাকে সবদিক দিয়ে অপরিচিত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তবে আশার কথা, বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই রোগের প্রতিষেধক অর্থাৎ ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এর প্রয়োগও শুরু হয়েছে। সেইসাথে এই রোগ সংক্রান্ত বিশ্বাসেরও বির্বতন ঘটেছে। শুরুতে মানুষের মাঝে এরোগ সম্পর্কিত যে বিশ্বাস আর্বিভূত হয়েছিলো সে সম্পর্কে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি আমাদের দেশে এই রোগে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ  এবং প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৮ মার্চ। শুরুতে কোনো ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হলে সামাজিকভাবে তাকে অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। সামাজিক অপবাদ বা স্টিগমা এসবের মধ্যে একটি। করোনা আক্রান্ত রোগীকে অনেক অমানবিক আচরণের শিকারও হতে হয়েছে। যেমন, বৃদ্ধ বাবা, মা বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য আক্রান্ত হলে তাকে দূর্গম চরে বা নির্জন বাগানে ফেলে আসার ঘটনাও ঘটেছে। শহরাঞ্চলে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ একজন আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাকে ফেলে সন্তানসহ স্বামী বা স্ত্রী পালিয়ে গেছে। হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে পরিবারের লোকজন তাদের মরদেহ গ্রহণ পর্যন্ত  করেনি। কেউ কেউ হাসপাতালে বাবা-মা, স্বজনদের ফেলে পালিয়ে  গেছে; পরে পুলিশ, প্রশাসনসহ স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় মৃতদেহের দাফন সম্পন্ন করতে হয়েছে।

করোনা আক্রান্ত রোগী, তাদের পরিবার, চিকিৎসক, নার্স, পুলিশসহ অনেককেই এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক বাড়িওয়ালা করোনা আক্রান্ত ভাড়াটিয়াকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে করোনা সংক্রমণের ভয়ে। করোনা আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নেবার মত যানবাহনও পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক ও সেবাদানকারী কর্মীরাও করোনা রোগীর কাছে আসেনি। এক ধরণের ভয় ও আতংক তাদের মধ্যে কাজ করেছে। সংকটকালে  যেখানে একে অপরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেবার কথা সেখানে ঘটেছে বিপরীত ঘটনা।

করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যক্তিগত আলোচনা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পরিমাণ গুজব ও আজগুবি তথ্য শুরুতে ছড়ানো হয়েছিল তাতে অনেকেরই জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান হয়েছে বিপর্যস্ত এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। শুধু আমাদের দেশেই নয় সারা বিশে^ই এরকমটি ঘটেছে। অনেকেই এর সাথে ধর্মীয় বিধানের ফতোয়াও জুড়ে দিয়েছেন যা আরো বেশী করে বির্পযস্ত করেছে করোনা আক্রান্ত ব্যাক্তি ও তার পরিবারকে। অনেকেই গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বিষয়টির কথাও তুলে ধরেছেন। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেছেন, “করোনা সংক্রান্ত ফেসবুকের ভূয়া তথ্য মানুষকে হত্যা করছে”। আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও গুজব প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগে মনিটরিং কমিটি গঠন ও সঠিক তথ্য প্রচারের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে এই চিত্রটি বদলে গেছে। করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে এখন আর কোনো ভীতি নেই। সাধারণ মানুষ এটাকে অন্যান্য সংক্রামক রোগের মতোই ধরে নিয়েছে। কেন এমনটি ঘটেছে? কারণ, তাদের বিশ্বাসের জায়গাতে বির্বতন ঘটেছে। তাদের জ্ঞানজগতে ও চিন্তাজগতে পরিবর্তন এসেছে। যেমন, তারা এখন মনে করে করোনা আক্রান্ত রোগীর গায়ে হাত দিলেই কারো করোনা হয়না, একমাত্র তার হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময়েই লালার সূক্ষ্ম কণার মাধ্যমে ভাইরাস তার শরীর থেকে বেরোতে পারে এবং তা কারো গায়ে লাগলে, পিঠে লাগলে, এমনকি তা খাবারের সাথে কারো পেটে গেলেও  সে আক্রান্ত হবে না। ভাইরাস একমাত্র কারো শ্বাসনালীর মাধ্যমে ফুসফুসে গেলেই সংক্রমণ সম্ভব। তবে বাইরে গেলে সর্বদা মাস্ক পরতে হবে এবং নাকে বা মুখে হাত দেওয়া যাবেনা। ভীড় এড়িয়ে চলতে হবে। তবে সবার মধ্যেই যে এ ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে তা নয়। অনেকেরই চিন্তাজগতে পরিবর্তন এলেও ব্যাক্তিগত অনুশীলণে তা দেখা যায়না। তাসত্ত্বেও মানুষ এখন আর আগের মত অন্ধবিশ্বাসী নেই। তারা বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। দৈনন্দিন কাজকর্ম করছে। গুজবে বা অপপ্রচারে তারা এখন আর কান দেয়না। কাজেই গুজব বা অপপ্রচার ছড়ায়ে এখন আর কারো লাভ হবেনা। কারণ, করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের বির্বতন ঘটেছে।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর