মানুষের জীবন, উৎসবের আনন্দ, মৃত্যুর শোক

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 11:52:35

ছবিতে উদ্ভাসিত হয়েছে 'বিশ্বজয়ের হাসি'। প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে, ট্রাকে, ভ্যানে বাড়ি ফেরার আনন্দ সবার মুখে। মিডিয়ায়, ফেসবুকে ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে ঈদ করতে গ্রামে যাওয়া মানুষের কষ্টকর যাত্রা শেষে এমনই সাফল্যের সচিত্র প্রতিবেদন ও নিজস্ব ওয়ালে লিপিবদ্ধ স্বরচিত বিবরণ।

প্রবল ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে কোনও উৎসবকালে গৃহযাত্রা মানেই এক ধরনের অঘোষিত যুদ্ধ। রাস্তার দীর্ঘ যানজট, অসম্ভব ভিড়, চাপাচাপি, গাদাগাদি, কুস্তিবাজী, ঠেলাঠেলি করে যানবাহনে জায়গা হাসিল করে তবেই স্বল্প পথও পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘসময়ে। মিডিয়ায় এইসব অকল্পনীয় মানবপিণ্ডের যাত্রাকালীন সম্মিলিত সমাবেশ শীর্ষ শিরোনামের জায়গা দখল করে।

অক্লান্ত বাঙালি এইসব অমানবিক দুর্যোগ ঠেলে বাড়িতে যাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হতে কখনোই কসুর করে না। অতীতের মতো এবারও, বৈশ্বিক মহামারির প্রলয়ঙ্করী পরিস্থিতিতেও, সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই এবং পথের নানাবিধ বিপত্তিকে কবুল করেই মানুষ একা কিংবা সপরিবারে গৃহযাত্রা করেছে। 

২০০ প্লাস রেকর্ড-ভাঙা ধারাবাহিক মৃত্যুচিত্র এবং ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের পরিস্থিতিকে মোটেও পরোয়া না করেই সম্পন্ন হয়েছে লক্ষ-কোটি মানুষের প্রাক-উৎসব প্রস্তুতিমূলক বাড়ি যাওয়া। পথের বিপদ, মৃত্যুভয়, রোগ সংক্রমণের ভীতি দমাতে পারে নি জনস্রোতের বন্যা। টগবগে বিপদের প্লাবনে ভেসে তারা সাফল্যের হাসি শেয়ার করেছেন। 

যারা বাড়ি যাচ্ছেন না বা যেতে পারছেন না, তারাও উৎসবের আবহে ঘরে বসে নেই। অনেকেই কোরবানির পশু কিনতে হাটের জনসমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যেসব স্থানে স্বাস্থ্যবিধির লেশমাত্র নেই এবং করোনা পরীক্ষা করে প্রতিদিন অনেক রোগি পাওয়া যাচ্ছে। ফুরফুরে আমেজে মার্কেটিং, আউটিং, ঘুরাঘুরিতে ব্যস্ত আছেন বহুজন, বহু পরিবার। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরের মল, মার্কেট, পাবলিক প্লেস থৈথৈ করছে নানা বয়সী মানুষে। লকডাউন তুলে দেওয়ার পর, সঙ্কুল বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে সবাই যেন বাঁধভাঙা জলের তোড়ে বাইরের পুরো জগত ভাসিয়ে দিচ্ছেন!

এইসব ঘটনা অতি-বাস্তব এবং মিডিয়ায় বহুলভাবে আলোচিত। একটি দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ:

সন্ধ্যা ৭:৩০টা। চট্টগ্রামের একটি জনাকীর্ণ মোড়। পরপর ৪-৫টি খাবার দোকান ও ক্যাফে। ভিতরে এত ভিড় যে রাস্তার উপরে বাড়তি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব চেয়ার-টেবিলই প্রায় গায়ে গায়ে। সামাজিক দূরত্বের কোনও বালাই নেই। তবে তা নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথাও নেই। প্রচুর তরুণ-তরুণী বসে কফি-স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন। অনেকেই আছেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সপরিবারে। আনন্দে খাচ্ছেন। মন খুলে গল্প করছেন। অট্টহাস্যে আড্ডা দিচ্ছেন। খেতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই কারুর মুখে মাস্ক নেই। তাঁদের প্রাণোচ্ছল হাসি-ঠাট্টা দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশজুড়ে করোনার প্রবল ঢেউ নিয়ে আতঙ্কিত চিকিৎসা-মহল। হাসপাতালে জায়গা নেই। অক্সিজেন অপ্রতুল। পরিস্থিতি সঙ্কটজনক। সবার জন্য সর্তক ও সাবধানতা অবলম্বন করাই জরুরি-গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

পেন্ডামিক পরিস্থিতির জরুরি-গুরুত্বপূর্ণ কাজ তথা সামাজিক দূরত্ব মেনে স্বাস্থ্যবিধি পালনের ক্ষেত্রে গৃহযাত্রায় অংশ নেয়া মানুষগুলো কিংবা ঘুরে বেড়ানো লোকজনের আদৌ কোনও মনোযোগ আছে বলে মনে করার সঙ্গত কারণ নেই। চরম পরিস্থিতির প্রতি অবলীলায় ভ্রূক্ষেপহীন হয়েই তারা তাদের কাজ ড্যামকেয়ার মনোভাবে করেই চলেছেন এবং আতঙ্কিত বা সতর্ক নয়, আনন্দিত হচ্ছেন।

চলমান মহামারির বিপজ্জনক পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হয়ে সামনেই নাকি করোনার তৃতীয় ঢেউ আসছে এবং সরকার সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এসব তথ্য ও খবর মানুষ মিডিয়ার বরাতে 'শুনে' থাকেন, নিজের জীবনে সে অনুযায়ী সতর্কতামূলক 'কাজে' পরিণত করেন বলে মনে হয় না। হলে, গৃহযাত্রায়, গরুর হাটে, হাট, বাজারে, শপিংমলে, হোটেল, রেস্তোরাঁয় উপচানো ভিড়, জনসমাগম, স্বাস্থ্যবিধির লঙ্ঘন হতো না। 

অথচ চিকিৎসকেরা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন, যেন সারাক্ষণ কোভিডবিধি মেনে চলা হয়। না হলে তৃতীয় ঢেউ আটকানোর কোনও রকম উপায় নেই। তারই মাঝে ডেল্টা, ডেল্টা প্লাস, কাপ্পা, ল্যাম্বডা— যে যখন পারছে ভয় দেখাচ্ছে। অথচ লক়ডাউন পরিস্থিতি অনেকটা শিথিল হওয়ায় মুক্তির স্বাদ পেয়েছে আমবাঙালি। তারা যত পারে এই সময়টা ঘোরাঘুরির মাধ্যমে উপভোগ করে নিচ্ছেন।

কেউ কেউ বেড়াতে যাচ্ছেন আত্মীয়দের বাড়ি কিংবা সুবিধামতো জায়গায়। যাত্রার টিকিট কাটার পর অনেকেই বেশ উচ্ছ্বসিত। তাদের মনোভাব এ রকম যে, ‘‘যাওয়ার আগে আমাদের কোভিড-পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। তবে সফরের জন্য পরীক্ষা করালে এখন সব ল্যাবই বেশ তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দিয়ে দেয়। তাই সেই নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই।" আর করোনা নিয়ে চিন্তা? ‘‘ধুর! জঙ্গলে বা গ্রামে আবার করোনা কীসের,’’ এমন রেডিমেড উত্তর তাদের মুখে।

গ্রামেও যে ঘরে ঘরে করোনার লক্ষণাদি বাড়ছে, বাড়ছে জ্বর, কাফি, শরীর ব্যাথা ইত্যাদি উপসর্গ, সে বিষয়েও অনেকের খেয়াল নেই। খেয়াল নেই করোনার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধির প্রসঙ্গেও। মানুষের জীবন, উৎসবের আনন্দ, মৃত্যুর শোক, এই মিলে যে একটি মারাত্মক ত্রিভুজ রচিত হয়েছে, অনেকেই এসব নিয়ে ভাবছেন বলে মনে হয় না। উৎসবের আনন্দই যেন বহুজনে পরম আরাধ্য। এমনকি, জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও উৎসব আর আনন্দই হয়ে দাঁড়িয়েছে চরম কাম্য বিষয়।

'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' মর্মে দেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করে অগ্রণী কবি মারা গেছেন বহু বছর আগে। বেঁচে থাকলে এই চলমান পরিস্থিতি দেখে কবি হয়ত আরও কঠিন কোনও চরণ লিখছেন। কিংবা অন্য কোন প্রাণীর প্রতীকে তুলনা করতেন উদাসীন মানুষের অবিবেচক আচরণকে। 

হায়! আফসোস!! কবি বেঁচে না থাকায়, মানুষগুলো দেখা হলেও, তাদৃশী প্রাণীর নাম জানা হলো না!!!  

এ সম্পর্কিত আরও খবর