সাহেদ-পাপিয়া-হেলেনার গডফাদারদেরও ধরতে হবে

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-27 03:47:56

বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। খবর পেয়ে ছুটে যায় সাংবাদিকরা, যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু র‌্যাব যেভাবে চার ঘণ্টা ধরে তার বাসায় অভিযান চালিয়েছে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল যেভাবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাইভ সম্প্রচার করেছে; তাতে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার একটু লজ্জাই লেগেছে।

হেলেনা জাহাঙ্গীর নেত্রী নন, অভিনেত্রী নন, সেলিব্রেটি নন, বিশাল ক্রিমিনালও নন। তিনি স্রেফ ফেসবুকে উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলে আলোচনায় আসতে চাওয়া একজন মানুষ। একজন ব্যবসায়ীকে বিয়ে করার সূত্রে নিজেও ব্যবসায়ী বনে গেছেন।

আর নানারকম ধান্ধাবাজী করে ব্যবসার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। অনুমতি ছাড়াই ‘জয়যাত্রা’ নামে একটি টেলিভিশন চালিয়ে সেটাতে বানিয়েছিলেন তার ধান্ধার অস্ত্র। সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ড এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার তৎপরতা দেখে মনে হয়েছে, তার একটাই উদ্দেশ্য আলোচনায় থাকা, এমনকি সেটা নেতিবাচকভাবে হলেও।

তিনি কখনো গাইছেন, কখনো ভুল উচ্চারণে নিজের টেলিভিশনে টক শো উপস্থাপন করছেন। ইউটিউবে নানান ভিডিও বানিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে, আসলে বলার চেষ্টা করছেন, দেখো আমি কে? ইফতার মাহফিলে গান গেয়ে বিতর্ক করছেন, বোট ক্লাবের নারী নির্যাতকের পক্ষ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। ‘মন্ত্রী গোণার টাইম নাই’ বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।

আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া কুমিল্লা-৫ আসনে মনোনয়ন চেয়ে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করছেন। এসব করে করে তিনি অবশ্য কম এগোননি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য বনে গিয়েছিলেন, হয়েছিলেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বনে গিয়েছিলেন। ফেসবুক প্রোফাইলে তার পরিচয়ে বহর অনেক লম্বা।

কিন্তু এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ‘চাকরীজীবী লীগ’ নামে একটি ধান্ধার দোকান খুলে মনোনয়ন বাণিজ্য করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। এখন তার সব গেছে। আওয়ামী লীগের উপকমিটি থেকে বহিস্কার হয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ হারিয়েছেন। আর নিজে এখন রিমান্ডে আছেন। পাপের পেয়ালা পূর্ণ হলে প্রকৃতি তার বিচার করে। হেলেনা জাহাঙ্গীরেরও তাই হয়েছে।

তিনি যে কোনো ভাবে আলোচনায় থাকতে চান বলে, আমি কখনো তাকে নিয়ে এক লাইনও লিখিনি। মনে হয়েছে, যাই লিখি তাতে তার লাভ হবে। তার নাম আরো কিছু লোক জানবে। তবে তাকে যে নাটকীয়তায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাও তার অপছন্দ হওয়ার কথা নয়। পুলিশ বা র‌্যাব তাকে ফোন করে ডেকে নিয়েও গ্রেপ্তার করতে পারতো। এভাবে গ্রেপ্তার করে তাকে বিশাল ‘নেত্রী’ বানিয়ে দেয়া হয়েছে যেন।

গ্রেপ্তারের সময় যেভাবে তিনি হাত নাড়ছিলেন, হাসছিলেন; আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছিল। তবে চার ঘণ্টার অভিযানে র‌্যাব যে বিদেশী মদ, বিদেশী মূদ্রা, হরিণের চামড়া, ক্যাঙারুর চামড়া, ওয়াকিটকি, ক্যাসিনো সামগ্রী উদ্ধার করেছে। এই উদ্ধার তালিকা দেখেও আমার হাসি পেয়েছে।

এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুরোনো ফর্মুলা। সরকারের সাথে কারো বনিবনা না হলেই র‌্যাব বা পুলিশ তার বাসায় অভিযান চালিয়ে বিদেশী মদ আর হরিণের চামড়া উদ্ধার করে। তারপর মাদক আর বন্যপ্রাণী আইনে দুটি মামলা হয়। যুবলীগের সম্রাট থেকে চাকরিজীবী লীগের হেলেনা- সবক্ষেত্রে একই ফর্মুলা।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় মদ, হরিণ আর ক্যাঙ্গারুর চামড়া, বৈদেশিক মূদ্রা আর ক্যাসিনো সামগ্রী আছে; এ খবর পেয়েই কি র‌্যাব তার বাসায় গেছে? নাকি অপরাধীদের আসল অপরাধ আড়াল করতে, তাকে বাঁচিয়ে দিতে এসব মদ আর চামড়া সামনে আনা হয়?

আমি নিশ্চিত গুলশানে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসার আশেপাশে অভিযান চালালেও এসব সামগ্রী পাওয়া যাবে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে অভিযানে যাওয়ার সময় তারা এসব সামগ্রী নিয়ে যান। তবে এবার তেমন হয়নি। হেলেনা জাহাঙ্গীরের মেয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এসবই তাদের বাসায় ছিল। তার ভাই মদ খান এবং তার লাইসেন্স আছে। চামগা দুটি তার মা গিফট পেয়েছিলেন।

বিভিন্ন সময়ে বিদেশ থেকে ফেরার পর কিছু বৈদেশিক মূদ্রা রয়ে গিয়েছিল। আর বাসা খেলার জন্য তারা ক্যাসিনো সামগ্রী কিনেছিলেন। হেলেনা জাহাঙ্গীরের অপরাধ যতটা রাজনৈতিক, ততটা ফোজদারী নয়। তার আসল অপরাধ হলো, রাজনৈদিত ধান্ধাবাজী। সেটার বিচার যেন ঠিকভাবে হয়। তার ফেসবুক আর ইউটিউবে অনেক কিছু আছে। জয়যাত্রা টেলিভিশনে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হতো, এটার প্রমাণও ফাঁস হওয়া টেলিসংলাপে আছে।

হেলেনা জাহাঙ্গীররা ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে চাইবে, থাকতে চাইবে; এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে তার ছবি এখন ফেসবুকজুড়ে। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া এবং এরশাদের সাথেও তার ছবি আছে। বৈবাহিক সূত্রে ব্যবসায়ী হেলেনা সিআইপি হয়েছিলেন, তার খায়েশ হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে ভিআইপি হওয়ার। বেশি চাইতে গিয়েই ধরা খেয়েছেন। কিন্তু আমি হেলেনা জাহাঙ্গীরের দোষ দেই না। তিনি চাইতেই পারেন।

কিন্তু কারা তাকে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য বানালো। সারা বাংলাদেশ দরকার নেই; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল এবং ইডেন কলেজের গত তিন দশকের ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সবাই কি আওয়ামী লীগের কমিটিতে বা উপকমিটিতে ঠাই পেয়েছেন? কীভাবে, কিসের বিনিময়ে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেত্রীদের বাদ দিয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য করা হলো।

এর আগে রিজেন্ট কেলেঙ্কারীর পর জানা গিয়েছিল সাহেদও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য। বাংলাদেশে কি আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতাকর্মীর অভাব পরেছে? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরুদ্ধ সময়ে ছাত্রলীগ করা নেতা-নেত্রীরা কোথায়?

পত্রিকায় দেখলাম, রিমান্ড শুনানীর সময় হেলেনা জাহাঙ্গীর দাবি করেছেন, তিনি ২৫ বার প্রথানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বিদেশে গেছেন। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা তদন্ত করে দেখতে হবে, কারা তাকে সফরসঙ্গী করলো, কারা তাকে উপকমিটিতে ঠাই দিল, কারা তাকে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বানালো। সাবরিনা, সাহেদ, পাপিয়া, হেলেনাদের ধরে শেষ হবে না। খুঁজে বের করতে তাদের গডফাদারদেরও। কাজটা কিন্তু একদম কঠিন নয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর