ছুটন্ত জনস্রোতের মর্মন্তুদ চিত্র!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:49:45

অতি-সংক্ষিপ্ত নোটিশে গার্মেন্টস খুলে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা অকল্পনীয়, ভয়াবহ, বিপজ্জনক এবং আত্মঘাতী। ঈদের ছুটিতে কর্মীরা দূর-দূরান্তে চলে গিয়েছিলেন। এখন যেভাবে তারা ঢাকায় ছুটে আসছেন, তা গণমাধ্যমে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। ছুটন্ত জনস্রোতের এ চিত্র খুবই দুঃখজনক, মর্মন্তুদ।

এই ঘোষণা আগে দিলে, নিদেনপক্ষে উপযুক্ত সময় হাতে রেখে জানানো হলে কারও বিশেষ কোনও ক্ষতি হতো? এখন কার লাভ হচ্ছে? হাজার হাজার শ্রমজীবি মানুষ যেভাবে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, তা এক কথায় মানবিক বিপর্যয়ের শামিল। জীবিকা বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিতে কার্যত বাধ্য করা হলো অগণিত মানুষকে।

মানুষগুলোর সামনে 'টার্গেট চাকরি' বাঁচানো। জীবন তুচ্ছ করে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছেন। শনিবার (৩১ জুলাই) সারাদিন প্রিন্ট ও ভিজুয়াল মিডিয়ায় ধাবমান মানুষের স্রোত ভেসে এসেছে। যেভাবে পারছে মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেছে। প্রধান পথ এড়িয়ে বিকল্প পথে ঢুকেছেন। করোনার কারণে লকডাউনে যানবাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটেও দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারীশ্রমিক।

barta24.com

করোনার সঙ্কুল পরিস্থিতিতে এই মানবস্রোত শুধু অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের বিপদই বহন করছেন না, সংক্রমণের ঝুঁকিতেও পড়েছেন। তাদের উদভ্রান্ত ও সংঘবদ্ধ গতির সামনে মুখথুবড়ে পড়েছে সামাজিক দূরত্বের বিধান। জনচাপে ছিটকে পড়েছে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির নিয়মকানুন। করোনার স্বাস্থ্যগত প্রটোকল এহেন পরিস্থিতিতে দৃশ্যত পরিণত হয়েছে প্রহসনে। করোনার মুখে চাকরি রক্ষায় লিপ্ত মানুষগুলোর জীবন হয়েছে 'বোঝার উপরে শাকেরা আটির মত' ভারী, দুর্বিষহ ও দুর্বহ।

barta24.com

জনচলাচল বিষয়ক নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা প্রণয়ন ও প্রয়োগের জন্য যারা কাজ করছেন, তারা চলমান বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি সামলানোর যথোপযোগী ব্যবস্থা নেবেন বলেই সবাই আশা করছেন। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মেধা ও যোগ্যতা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সকলেই প্রত্যাশা করেন।

যদিও বিগত রোজার ঈদের পর যেমন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল, সদ্য-বিগত কোরবানির ঈদের পরেও তেমনই অরাজকতা দেখা গেছে। বিরূপ অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে সুষ্ঠুতা বিধানে কাজে লাগে নি। যেহেতু করোনা এখনও চলে যায় নি, সেহেতু ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পন্থা ও সতর্কতা অত্যাবশ্যক। নচেৎ এইসব কারণে মহামারির সামাজিক ট্রান্সমিশন আর হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের অবসান হবে না।

barta24.com

বাংলাদেশে নিয়ম আর অনিয়ম চলে সমান্তরালে। শৃঙ্খলার চেয়ে তীব্র হয় বিশৃঙ্খলা। করোনার মারণ আঘাতের কারণে আমাদের অন্তত শৃঙ্খলা বিধানের পথে চলার সময় এসেছে। ফ্রিস্টাইল জীবনের বাস্তবতায় আন্তর্জাতিকভাবে সর্বজন স্বীকৃত কিছু কিছু শৃঙ্খলা ও বিধি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই আমাদের সকলকে মেনে নিতে হবে। ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক কারণে এই শৃঙ্খলা ও বিধি ভঙ্গ করা মোটেই কাম্য হবে না। বরং তা হবে বিপদের নামান্তর।

barta24.com

বাংলাদেশের নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে যে নেতিবাচক ধারণা ও চিত্র, তা অতি অবশ্যই করোনা মহামারির মারাত্মক আঘাতকে বিবেচনায় রেখে বদলাতে হবে। কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ'। পণ্ডিত নীরোদ সি. চৌধুরী 'আত্মঘাতী বাঙালি' শীর্ষক একটি পুস্তকও লিখেছিলেন। এগুলো অনেক আগের কথা হলেও আমাদের সত্বা ও সংস্কৃতিতে 'উদ্ভট উট' আর 'আত্মঘাতী' প্রবণতা সন্তর্পণে লুক্কায়িত। এসব অপধারা যেন সুযোগ পেলেই বিষধর সাপের মতো ছোবল হানতে না পারে, এজন্য কর্তাব্যক্তিদের সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে।

barta24.com

ফলে সঙ্কটকালে মানুষের জীবন এবং জীবিকার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর একটি যৌক্তিক 'রোড ম্যাপ' প্রস্তুত করাই জরুরি। ক্রান্তিকালে এ দুটোর মধ্যে ভারসাম্যহীনতার মাধ্যমে আকস্মিকভাবে গৃহীত কোনও কোনও সিদ্ধান্ত বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। বার বার জনস্রোতের সৃষ্টি হলে আর্থ-সামাজিক সমস্যার মতোই তীব্র জনস্বাস্থ্যগত সমস্যার যে লাগামহীন উল্লম্ফন ঘটবে, তা চলমান মহামারির প্রচণ্ড বিপদকে দাবানলে রূপান্তিত করতে পারে। অতএব, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে হাতে সময় নিয়ে এবং ভালো-মন্দের প্রতিটি দিক ভেবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর