'চরকি' কেমন ঘুরছে?

, যুক্তিতর্ক

মনোয়ার রুবেল | 2023-09-01 22:52:37

বাংলাদেশে সম্প্রতি চরকি নামে একটি ওটিটি প্লাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে। ইতিপূর্বে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন ওটিটি প্লাটফর্ম বাংলাদেশে ছিল না। দুএকটা হয়তো আছে, তারা মোবাইল অপারেটর নির্ভর। কয়েকটি আছে কিছুটা ইউটিউব, কিছুটা ফেসবুক, কিছুটা ওটিটির নিজের ও বাকীটা লাইভ টিভি চ্যানেল মিলিয়ে মিশিয়ে। চরকি সে তুলনায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ঘরানার। অ্যাপসটির পরিচালক রেদোয়ান রনি। তিনি একজন নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালকও।

চরকি আসার পূর্ব থেকে বাংলাদেশে নেটফ্লিক্স, আমাজান প্রাইম, জিফাইভ জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের হইচই নামে প্লাটফর্মটিও বাংলাভাষীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তার মূল কারণ কিছু বাংলাদেশি কন্টেন্ট। হইচই-এ পরপর চঞ্চল চৌধুরী ও মোশারফ করিম অভিনীত 'তাকদীর' ও 'মহানগর' ওয়েব সিরিজ ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। হইচই বৌদি বিষয়ক আঠারোর্ধ কন্টেন্ট বানিয়ে দুর্নাম কুড়িয়েছিল বেশ। এসব দেখতে কিছু নবউদিত কিশোর ও কিছু অস্তগামী বৃদ্ধ উৎসুক হলেও আপামর বাঙালি 'হইচই' নিয়ে হৈচৈ করছে চঞ্চল চৌধুরী ও মোশারফ করিমকে দেখে। তাদের ভারতীয় কিছু ভালো কন্টেন্টও ছিল, তবে সেগুলো বৌদির বদনামে এতদিন মুখ দেখাতে পারেনি।

বাংলাদেশিদের মধ্যে নিজেদের কোন প্লাটফর্ম নেই সেই আক্ষেপ তৈরি হওয়ার আগেই চরকি এসে উপস্থিত হয়েছে। তবে চরকির দুর্ভাগ্য তার সব প্রতিদ্বন্দ্বীই আন্তার্জাতিক কিংবা ভারতীয়। বহিঃবাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। ফলে দর্শক ঠকানো কিংবা গা ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। চরকি এবং চরকির কন্টেন্ট নিয়ে যখনি পোস্টমর্টেম হবে তখুনি আন্তার্জাতিক ওটিটিগুলোর সাথে তুলনা করা হবে। এটা নিয়ে সবসময় সচেতন থাকতে হবে।

চরকির প্রথম প্রোডাকশন ছিল 'মরিচীকা'। এককথায় যদি বলি, এটা দর্শকদের হতাশ করেছে। অভিনয়, গল্প, ডায়ালগ সবক্ষেত্রই হতাশাজনক। ইউটিউবে রিভিউয়াররা বলছেন মরিচীকা দেখা শুরু করে শেষ করতে পারেননি বা স্কিপ করে করে এগিয়েছেন। মরিচীকার ব্যর্থতা চরকির আগমনকে হুমকিতে ফেলে দিত, যদি না দ্রুতসময়ে ঊনলৌকিক নামে আরেকটি এন্থলজি সিরিজ তারা নিয়ে আসতেন। এন্থলজি সিরিজে ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলা হয়। ঊনলৌকিক এ পাঁচটি ভিন্ন গল্প বলা হবে। তারা প্রথমপর্বের নাম রেখেছেন, 'মরিবার হলো তার সাধ'। এই গল্পে এক লোক মরতে চায়। এজন্য তিনি নানান কায়দা কানুন এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। মোস্তফা মনোয়ার অভিনয় করেছেন। আমরা জিফাইভের 'লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান'এ এই অভিনেতাকে দেখেছি। তিনি ঊনলৌকিক- এ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তার সাইক্রিয়াটিস্ট চরিত্রে ছিলেন গাজী রাকায়েত। আয়নাল লস্কর খ্যাত এই অভিনেতা স্বনামেই অনবদ্য। বাংলাদেশ এই অসাধারণ অভিনেতাকে কখনো খুব বড় কাজে লাগিয়েছে মনে পড়ে না। কিন্তু তিনি যেখানে যতটুকু থাকেন আন্তার্জাতিক ছাপ রেখে যান।

'মরিবার হলো তার সাধ 'এ যেটি খুবই প্রাণবন্ত মনে হলো তা হলো কবিতা বর্ণন এর ঢঙ। পর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে জীবনানন্দ দাশের আটবছর আগে একদিন কবিতাটি পাঠ করা হচ্ছিল । দৃশ্যটি এমন একদল লোক আত্মহত্যা করছে, তাতে একজন নেতৃত্ব দিচ্ছেন কবিতা পড়ে। আবৃতির ভরাটগলা পুরো দৃশ্যে গা ছমছম ভাবে এনে দেয়। থিয়েটারে প্রায়শই কবিতায় দৃশ্যকল্প বর্ণনা করা হলেও, টিভি বা মোবাইল সিরিজে কবিতার এমন চমৎকার উপস্থাপন নতুন। এই অনবদ্য কনসেপ্টটির জন্য পরিচালক অনেকদিন অন্য নাট্যকারদের মনে গেঁথে থাকতে পারেন, অনুকরণীয় হতে পারেন।

এক সপ্তাহ ব্যবধানে একই সিরিজের দ্বিতীয় গল্প দেখলাম 'ডোন্ট রাইট মি'। এটি ভিন্ন একটি গল্প। একজন লেখকের লেখা গল্পের সাথে এক যুবক তার জীবনের মিল খুঁজে পায়। তার চেনা চরিত্রগুলোর নাম, এমনকি প্রেমিকার নামও একই। যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল মন্ডল। যিনি এর আগে হইচই এর প্রোডাকশন 'তাকদীর'এ চঞ্চল চৌধুরীর সাথে পর্দা শেয়ার করেছেন। মন্টু চরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় বাংলাদেশতো বটেই পশ্চিমবঙ্গেও নজর কেড়েছে। এই গল্পে লেখকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর।

ডোন্ট রাইট মি'তে সোহেল মন্ডল তার ভবিষ্যৎ জানতে হন্যে হয়ে লেখকের পিছু লেগে থাকে। তিনি লেখককে ক্রমাগত চাপ দেন সে গল্পের ভবিষ্যৎ লিখতে। এমন গল্প বাংলাদেশে নতুন। এই সিরিজে পরিচালকের অসাধারণ বুননে প্রতিটি গল্প অনবদ্য হয়ে উঠেছে। তবে দর্শক হতাশার জায়গাটুকু নিয়ে না বললেই নয়। প্রতিটি গল্প মাত্র একুশ মিনিটে শেষ করা হয়েছে। টেলিভিশন নাটকের ধারাবাহিক সিরিজগুলোতে আমরা দেখি আধ ঘণ্টায় শেষ করা হয়। বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য কাটছাটেরপর প্রতিপর্ব একুশ মিনিটে গিয়ে ঠেকে। কিন্তু ওটিটি প্লাটফর্ম তেমনটি হতেই হবে কেন? এখানে বিজ্ঞাপনের সময়ভোগ নেই। দৈর্ঘ্যের রক্ষণশীলতা নেই। টিভি চাঙ্কের লড়াই নেই। তাহলে একুশ মিনিটই কেন? ঊনলৌকিক এ প্রতিটি গল্প যে রেখায় এগুচ্ছিল তা আরো বিস্তৃত হতে পারতো। চরিত্রগুলো আরো প্রসারিত হলে দর্শকের তৃষ্ণা মিটতো। তবে পরিচালক মাত্র একুশ মিনিট সময়ে প্রতিটি চরিত্রে যেভাবে আলো ফেলেছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। এই সময় ব্যাপ্তিতেও গল্পে কোন তাড়াহুড়ো নেই। অত্যন্ত ধীরস্থির গল্প এগিয়েছে। এটাও কম প্রশংসার বিষয় নয়।

চরকি ঈদে মুক্তি দিয়েছে 'ইউটিউমার' নামে একটি দীর্ঘ নাটক। যদিও তারা তাদের প্লাটফর্মে এটাকে সিনেমা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে নাটকের যে ঢঙ সে ঢঙেই এটা বানানো। ওয়েব প্লাটফর্মগুলোর সিনেমার গল্প বলার শৈলীতে আমরা পরিচিত। ওটিটি সিনেমার একটি স্বতন্ত্র ঢঙ রয়েছে। তাই বাংলাভাষায় সিনেমা বা সিরিজ যাই তৈরি হোকনা কেন তার সাথে বিদেশি সিরিজ বা সিনেমার তুলনা চলবে। আবার নাটক নামে আলাদা যে একটি শিল্প বাংলাদেশে রয়েছে তারও নিজস্ব স্বাতন্ত্র রয়েছে। বিশ্বের অন্যপ্রান্তে হয়তো দুটোই একই জিনিস কিন্তু এখানকার দর্শকের কাছে নাটক বা সিনেমা দুটো আলাদা জিনিস। তাই কোন প্রোডাকশনকে নাটক বা সিনেমার বলার পর সংজ্ঞায়ন যথাযথ না হলে দর্শক হতাশা বাড়ে। ইউটিউমারকে নাটক বলাই যুক্তিযুক্ত।

ইউটিউমার ঈদের একপর্বের টিভি নাটকের মতো হালকা গল্পের নাটক। ইউটিউমারে গল্পে ও ডায়ালগে গভীরতা নেই। বাংলাদেশে কিছু নাটক তৈরি হয় যেখানে গল্প থাকে কিন্তু ডায়লগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ লেখা থাকেনা। শ্যুটিং সেটে পরিচালক ডায়ালগ কী হবে তা বলে দেন। অভিনেতা নিজের মতো সে ডায়ালগ মনের মধ্যে তৈরি করেন এবং বলেন। এসব ডায়লগের গভীরতা কম হয়। ইউটিউমার দেখে তেমনই মনে হলো। স্ক্রিপ্টেড ডায়ালগ ভারি হয়। হিউমার তীক্ষ্ণ হয়।

ইউটিউমার মূলত হালের দুই যুবকের খ্যাতিমান হয়ে ওঠার বাসনা নিয়ে গল্প। যারা একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে। লাইভে এসে একজন মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত দাবি করে কান্নাকাটি করেন। ভাইরাল হওয়ার জন্য এরচেয়ে সহজপথ তাদের ছিল না। তারা ভাইরাল হন। এভাবেই গল্প এগুতে থাকে। তবে এই গল্প বা নাটকে যেটি বেশি লক্ষণীয় নির্মাণে কোথায় যেন খাপছাড়া ব্যাপার কিছু ছিল, অস্থিরতা ছিল। রসবোধে স্থূলতা ছিল, অভিনয়েও। হালের ভিউ সন্ধানী বাংলা নাটকের মতো টিনেজ হাহাহিহিতে ভরা এবং সবশেষে একটা ঈশপের গল্পের মতো নৈতিক শিক্ষা দেয়ার চেষ্টাও থাকে এমন নাটকে। এসব নাটকও কিছু দর্শক দেখেন, কিন্ত সেটা ইউটিউবে, ফ্রি তে। টাকা দিয়ে নয়।

আরেকটি জিনিস চোখে পড়ার মতো বাংলাদেশের কয়েকজন পরিচিত ইউটিউবারদের ইউটিউমার-এ দেখানো হয়েছে। এটাও সস্তা বিপণন কৌশল মনে হতে পারে কারো কাছে। যেটা ইউটিউবে হয়, একজন ইউটিউবার অন্য ইউটিউবারদের দিয়ে কোলাবরেশন ভিডিও তৈরি করে যে যার নিজের চ্যানেল প্রমোট করাতে চান। এখানেও তেমন মনে হতে পারে। মনে হতে পারে ইউটিবারদের দিয়ে পরিচালক ইউটিউমার এর দর্শক ধরবার চেষ্টা করছেন। আবার সেটা নাও হতে পারে। একই সাথে বলা বাহুল্য, নাটক বা সিনেমায় গল্প যখন বলা হবে দর্শকদের কাছে গল্পকারের কল্পনাশক্তির পরীক্ষা দিতে হয়। গল্পকার তার মস্তিষ্ক খাটিয়ে বিভিন্ন চরিত্র তৈরি করবেন। সেগুলো বাস্তবের কোন চরিত্র দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারেন, কিন্তু সেটা অশোভন নয়। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ার একটি মানুষকে সরাসরি পর্দায় নিয়ে আসলে দর্শকের নাটকের কল্প জগতে ঢুকতে সমস্যা হয়। যেটা এই নাটকে হয়েছে। আবার গল্পের শেষে সদ্য জেল খাটা টিকটক অপুকে মোটিভেটিভ ক্যারেক্টার হিসেবে দেখানো পরিচালকের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি অপরিপক্কতার প্রকাশ করে। শেষ দৃশ্যে পুরো নাটক/সিনেমাটিই যেন জলে গিয়ে পড়লো।

বারবার 'গতানুগতিক' শব্দটি উল্লেখ করছি কারণ যা আমরা টিভিতে প্রতিনিয়ত বিনামূল্যে দেখি তা ওটিটিতে টাকা খরচ করে কেন দেখব সেটা সংশ্লিষ্টদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। বৃহৎ বিপণন কৌশল বা চাকচিক্যময় টিজার দিয়ে, যেভাবেই শুরুটা করি কেন দিনশেষে কন্টেন্টটি উপভোগ্য হতে হবে। এটা নির্মাতাদের মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে আন্তার্জাতিক বাংলা প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে মার খেতে হবে। মনে রাখতে হবে টিভি কন্টেন্ট দিয়ে ওটিটি চলবে না। এমনকি ইউটিউব কন্টেন্ট কপি করেও ওটিটি চালানো যায় না। কারণ ওটিটি কেউ ফ্রি দেখে না। ইউটিউবারদের ফলোয়ার এবং ওটিটির দর্শকের রুচিবোধ আলাদা, সেটা মাথায় রাখতে হবে।

এতো গেলো কন্টেন্ট। কিন্তু টেকনিক্যাল কিছু বিষয়ও আছে। যেমন চরকিতে ধীরগতির ইন্টারনেটে লোডিং সমস্যা প্রকট। ঈদের ছুটিতে আমি ফেনীর যে প্রত্যন্ত গ্রামে বসে এই রিভিউ লিখছি সেখানে নেটফিক্স বা হইচই বাফারিং ছাড়া চললেও চরকির ভিডিও দূরে থাক ইমেজ প্রিভিউও পাওয়া যাচ্ছে না। এসব জায়গাগুলোতে উন্নতি করতে হবে দ্রুত। আরেকটি বিষয় কন্টেন্ট বাড়াতে হবে। মাসে দুই তিনটি কন্টেন্ট যথেষ্ট নয়। মহামারিকালে একজন ইউজার দৈনিক কত ঘণ্টা স্ক্রিনে থাকেন, কতঘণ্টা  তিনি মুভি দেখতে চান এসব বিষয়ে ভাবতে হবে।

তবে যাই হোক, চরকি ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকেই এই ওটিটির কন্টেন্ট দেখতে চাচ্ছে। এটা নিজেদের প্লাটফর্ম। দর্শক চায় ঊনলৌকিক বা লাল কাতান নীল ডাকাত এর মতো কন্টেন্ট চরকি আরো দিক। আশা করি চরকি সেটা পারবে। কারণ, বাংলাদেশ নাটকের দেশ, কন্টেন্ট এর অভাব এদেশে নেই।

মনোয়ার রুবেল: লেখক

এ সম্পর্কিত আরও খবর