মিশন ঢাকা: ভূলুণ্ঠিত মানুষের মূল্য, শ্রমের মর্যাদা ও নিরাপত্তা!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 14:14:46

পুরো এপিসোড দেখে মনে হতে পারে, যেন যুদ্ধাবস্থা চলছে। পঙ্গপালের মতো ছুটছে মানুষ। তাদের সামনে মিশন ঢাকা, টার্গেট চাকরি।

যে পন্থায় মানুষেরা ঢাকা এসেছেন, তা শুধু বিপজ্জনকই নয়, মানুষের মানবিক ও জীবনের মূল্যকেও অবদমিত করেছে। বাসে, ট্রাকে, লঞ্চে চরম বিপদসঙ্কুল পরিবেশে যাত্রাকালে তাদেরকে গরু, ছাগলের মতো ঠাসাঠাসি করে আসতে হয়েছে। পথেই মারা গেছেন বেশ কয়েকজন। পুরো প্রক্রিয়ায় সামান্যতম মানবিক মূল্য, ইজ্জত, আব্রু, মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষিত হয় নি।

অথচ কথায় কথায় আমরা মানুষের মূল্য ও শ্রমের মর্যাদা বিষয়ক উচ্চ মার্গীয় নসিহত শুনে থাকি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই, এবার চাক্ষুষ দেখা গেলো।

যেকোনও শ্রমের যে একটি স্বীকৃতি, সম্মান, মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে, সেটাও পোষাক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় নি। ইচ্ছামতো পালের পশুদের মতো তাদের আনা ও বিদায় করা যায়, বাস্তবতা যেন এমন।

গত কয়দিনের অভিজ্ঞতায় ভূলুণ্ঠিত মানুষের মূল্য, শ্রমের মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়টিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অকস্মাৎ ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শ্রমিক, ছাত্র বা সমাজের কোনও কোনও অংশের প্রতি এমনই আচরণ করা হয়, যাতে তাদের মূল্য, মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো বিবেচনাতেই নেওয়া হয় না।

ফলে সামাজিক পরিসরে ও জন চলাচলে মানুষের মূল্য, শ্রমজীবীর মর্যাদা এবং তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের ক্ষেত্রে যে মানসম্পন্ন পরিবেশ, পরিস্থিতি ও ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, তা থেকে আমরা কত পিছিয়ে আছি, সেটা খোলা চোখেই দেখা গেলো। একবিংশ শতকরের সুপারসনিক যুগে এহেন মধ্যযুগীয় ধারা একেবারেই অকাম্য।

তদুপরি শ্রমজীবীর মর্যাদার বিষয়টিও সমুন্নত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। জীবন ও সম্মানের মূল্য, পেশার মর্যাদা এবং সামগ্রিক নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে তাদের সম্মানজনক জীবন ধারণের নিশ্চয়তা বিধান করা সংশ্লিষ্ট  সকলের দায়িত্ব।

গত কয়দিনের উড়ন্ত মানবস্রোতের মর্মন্তুদ চিত্র থেকে দেশের বিকেন্দ্রীকরণের তাৎপর্যও নতুন করে সামনে এসেছে। সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হলে জন ও যোগাযোগের যে অভাবনীয় চাপ সৃষ্টি হয়, তা সামলানোর অবকাঠামো ও মানবসম্পদ মোটেও নেই। তদুপরি, ঢাকায় আবাসিক, অনাবাসিক, শিল্প, কারখানা, রাসায়নিক সামগ্রী প্রস্তুতের যে মাখামাখি রকমের বিশৃঙ্খল ও পরিকল্পনাহীন পরিস্থিতি বিরাজমান, তার ভয়াবহ বিপদ এড়ানোর জন্যেও বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে জোরেশোরে ভাবতে হবে।

তবে, সদ্য-অর্জিত প্লাবনের মতো জনস্রোতের অভিজ্ঞতাটি ভবিষ্যতের বিপদ এড়ানোর জন্যে যথাযথভাবে কাজে লাগানোই অতি আবশ্যক। একেকটি বিপদ ও সঙ্কট এলে দ্রুত সেটা ভুলে গেলে বিপদ আসতেই থাকবে এবং সবাইকে অসহায় ও বিপন্ন করবেই। এসব থেকে মুক্তির জন্য আগাম প্রস্তুতি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা ও চৌকশ কর্মসূচির কোনও বিকল্প নেই। এই সত্যটি সংশ্লিষ্টদের হৃদয়ঙ্গম করতেই হবে।

বার বার যদি লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরিধান সহ স্বাস্থ্যবিধির সবকিছুই তছনছ হয়ে যায়, তাহলে মহামারির হানা না কমে বরং দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় সার্বিক সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত পূর্বপ্রস্তুতির পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব সংগৃহীত করোনার ভ্যাকসিনগুলো যুদ্ধাবস্থার মতো স্পিরিট নিয়ে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা জরুরি। পাশাপাশি আর কোনও সামাজিক মানবস্রোত সৃষ্টি হতে না পারে, সেটাও সুনিশ্চিত করা অপরিহার্য। 

 ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর