সামাজিক জীবনে বিপদের 'লাল বার্তা'!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 19:48:52

মিডিয়া নামধারী, অভিনেত্রী, মডেলদের ঘিরে যেসব খবর প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে নগর জীবনের অন্ধকার জগতের অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে। ফাঁস হয়েছে এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ার ছদ্মাবরণে নেশার নীল পর্দা। ভদ্রবেশীদের জঘন্যতম আচরণের বিষয়গুলোও সামনে এসেছে। জাল-জালিয়াতি, পর্নোগ্রাফি, নারীদের দিয়ে দেহব্যবসা ও যৌন অপরাধের মুখোশ কিছুটা খুলেছে। বিয়ে ও সম্পর্কের নামে যথেচ্ছাচার এবং ব্ল্যাকমেলিং-এর অনেক ঘটনার কথাও জানা যাচ্ছে। এসবই সুস্থ, স্বাভাবিক সামাজিক জীবনের জন্য বিপদের 'লাল বার্তা' স্বরূপ।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও সম্প্রতি এমন ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে, যাতে উভয় দেশেরই নায়ক, নায়িকা, মডেল, প্রযোজক, পরিচালক, নায়িকা-পতি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির নাম এসেছে। নামসর্বস্ব মিডিয়া, শিল্প ও সংস্কৃতির আড়ালে এসব অপরাধের ঘুর্ণাবর্তে সংঘটিত হয়েছে বহুবিধ অপকর্ম। কয়েকজন ইতিমধ্যে আটক হয়েছেন। তাদের সাঙ্গপাঙ্গ, সহযোগীদেরও ধরা হয়েছে ও তদন্ত চলছে।

এইসব চাঞ্চল্যকর ঘটনায় হুমায়ূন আহমেদের নাটক 'কোথাও কেউ নেই'-এর কথা মনে পড়ছে, যাতে কেন্দ্রীয় চরিত্র 'বাকের ভাই' সবার হৃদয় ছুঁয়ে ছিল। উন্মোচিত হয়ে ছিল সমাজের জঘন্যতম অন্ধকার দিক। মানুষ জেনেছিল 'কুত্তাওয়ালী', মডেল মাফিয়া, অদৃশ্য গডফাদারের বিষয়ে। মনে হচ্ছে সেসবই আরও প্রবলভাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাই গুন্ডা প্রকৃতির লোক এবং তার সঙ্গী ছিল "বদি" আর "মজনু", তারা তিনজনই মোটরসাইকেলে করে মহল্লায় চলাফেরা করতো। অধিকাংশ সময় মোটরসাইকেল চালাতো মজনু, বদি বসতো পিছনে, বাকের ভাই বসতো মাঝে। বাকের ভাইয়ের একটা মুদ্রাদোষ ছিল, সে একটা চেইন হাতের তর্জনিতে অনবরত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচাতো, আবার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে আবার প্যাঁচাতো। সক্রিয় ডায়লগ না থাকলে প্রায়ই তাকে এরকম করতে দেখা যেত।

বাকের ভাইকে পছন্দ করতো "মুনা"। মুনা এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সে চাকরি করে এবং তার মামাতো ভাই-বোনদের দেখাশোনা করে। বাকের ভাই এলাকার মাস্তান হলেও অধিকাংশ মানুষ তাকে ভালোবাসতো, কারণ সে ছিল সত্যের পূজারী-নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে যেমন কুন্ঠিত হতো না, তেমনি সমাজের অন্যায়কেও মুখ বুজে মেনে নিত না, নিজের গুন্ডাদের দিয়ে তা কঠোর হস্তে দমন করতো।

ঘটনাপ্রবাহে বাকের ভাই রেবেকা হক নামের এলাকার প্রভাবশালী এক নারীর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ঐ নারী তার বাড়িতে অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন, বাকের ভাই তা জানতে পেরে প্রতিবাদ করে। এই প্রভাবশালী নারী তার বাড়িতে কুকুর পালন করতেন বলে বাকের ভাই তাকে কুত্তাওয়ালী বলেন। এরই মধ্যে রাতের অন্ধকারে "কুত্তাওয়ালীর" দারোয়ান তার বাড়িতে খুন হয়। ফাঁসানোর জন্য এই খুনের দায় দেয়া হয় বাকের ভাইকে, সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেয় কুত্তাওয়ালী'র সাজানো সাক্ষী এলাকার নব্য ছিনতাইকারী মতি। যদিও পদে পদে মতির মিথ্যা সাক্ষ্য বাকের ভাইয়ের উকিল ধরিয়ে দিচ্ছিলেন আদালতের কাছে, কিন্তু এদিকে বাকের ভাইকে ফাঁসানোর জন্য কুত্তাওয়ালী লোভ দেখিয়ে বাকের ভাইয়েরই সাগরেদ বদিকে হাত করে নেয়। বদি নিরুপায় হয়ে আদালতে শপথ করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বাকের ভাইকে পাকাপোক্তভাবে ফাঁসিয়ে দেয়।

আদালত ঐ খুনের দায়ে নির্দোষ বাকের ভাইকে মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেন। বাকের ভাইয়ের পক্ষে উকিল হিসেবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন উকিল। আদালতের এই সিদ্ধান্তে যেন মরে যায় মুনার মন। এদিকে মুনার ঘরের সবাইও বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি জমান। এই একাকিত্বের দিনে এক ভোরে, আধো অন্ধকারে, চারদিকে যখন ফজরের আজান হচ্ছিল, জেল গেট দিয়ে বাকের ভাইয়ের লাশ বের করে দেয়া হয়। কেউ ছিল না সেই লাশ গ্রহণ করার জন্য মুনা ছাড়া। সৎকার করার পর, মুনা বড় একা হয়ে যায়। তার যেন আর কেউ রইলো না কোথাও। নাটকের নামকে সার্থক করে মুনা ধারাবাহিকের শেষ দৃশ্যে ভোরের আলো অন্ধকারে ছায়া হয়ে একা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকে।

নাটকটি অনেক ভালো ছিলো ও তা ছিলো কালজয়ী আধুনিক বাংলা টেলিভিশন নাটকের একটি। সেই নাটকের দৃশ্যপটই যেন বাস্তবে আবার দেখা যাচ্ছে একালের মডেল মাফিয়াদের অবৈধ ও অনৈতিক কার্যকলাপে। একের পর এক মিডিয়া নামধারী, নায়িকা, মডেল যে অপরাধ সাম্রাজ্য তৈরি করেছে তা নাটকের কুত্তাওয়ালীকে হার মানায়।

একের পর এক বিয়ে করা, একদল তরুণীদের দিয়ে যৌন ব্যবসা করা, ব্লু ফিল্ম ও পর্নো ছবির মাধ্যমে টাকা কামানো, মদ ও মাদকের আসর জমিয়ে মোটা টাকাওয়ালা মক্কেলদের জড়ো করা, ব্ল্যাকমেল ইত্যাদি বহুবিধ অপরাধের ফিরিস্তি এখন মিডিয়ার মূল আলোচ্য বিষয়।

এইসব অপরাধের কারণ নির্ণয় ও বিচার করা অবশ্যই জরুরি। তার মতোই জরুরি, অভিজাত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অবৈধ কার্যকলাপের মেলা-মচ্ছব চলছে, তাকে চিহ্নিত ও মূলোৎপাটন করা। কেননা, এসব অপকর্ম সুস্থ,  স্বাভাবিক সামাজিক জীবনের জন্য বিপদের 'লাল বার্তা' বহন করে। সামাজিক কাঠামোকে বিকৃত ও ধ্বস্ত করে এবং উঠতি তরুণ-তরুণীদের মাদক ও যৌনতার জালে আবদ্ধ করে, যা থেকে হত্যা, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ইত্যাকার আরও অনেক বিপজ্জক ঘটনা ঘটছে এবং তরুণ শিল্পপতি, কাঁচা টাকার মালিক, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ থেকে বহু পরিবারের ছেলেমেয়েদের নাম আসছে।

অবৈধ পন্থায় দ্রুত কোটি কোটি টাকা, বিত্ত, বৈভব, গাড়ি, বাড়ির মালিক হওয়ার স্রোতে ভাসমান এইসব অপরাধচক্রে জড়িতরা মোটেও একা নয়, তাদের পেছনে আছে শক্তিশালী অদৃশ্য গডফাদার। যে কারণে এরা দিব্যি এতো কিছু করতে পারছে। অপরাধী এবং অপরাধীদের যারা নেপথ্যে থেকে পুতুল নাচের মতো নাচাচ্ছে, উভয়কে শনাক্ত ও দণ্ডিত না করলে এহেন অপধারা বন্ধ হবে না এবং সামগ্রিকভাবে পুরো সমাজ ক্রমশ বিপদের গহ্বরে চলে যাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর