২০ মাসে ২০ কোটি ১২ লাখ সংক্রমণে বিশ্বস্বাস্থ্য বেসামাল

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-27 02:27:30

আগস্ট ০৫, ২০২১ তারিখে বিশ্বে করোনার সংক্রমণ শুরুর ২০ মাস পার হয়ে গেল। এরই মধ্যে করোনায় সংক্রমণ সংখ্যা ২০ কোটি ২০ লাখ ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী মৃত্যু হয়েছে ৪২ লাখ ৭০ হাজারের অধিক। মধ্যিখানে ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার প্রকোপ কমে গেলে অফিস, কারখানা, রেঁস্তারা, সী-বীচ খুলে দিলে ঘরবন্দী মানুষ বাইরে বের হয়ে উল্লাস করে পার্টিতে শ্যাম্পেন ছিটিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় সেসকল দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তারে পুনরায় সংক্রমণ ও মৃত্যু শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগস্ট ০৫ তারিখে সংক্রমণ পুনরায় এক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় একদিনে মারা গেছেন ১৬০০ জন, ব্রাজিলে ১৩০০ জন এবং ভারতে ৫৬০ জন। সেই সঙ্গে একই দিনে বাংলাদেশে এ যাবতকালের রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে- ২৬৪ জনের। যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ৯৮% ডেল্টা ভেরেয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

পাশাপাশি একই সময়ে মরণব্যাধি ডেঙ্গির প্রকোপে নাস্তানাবুদ রাজধানীবাসী। আগস্ট ০৫, ২০২১ তারিখে ডেঙ্গিতে  নতুন করে ২১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ১০ বছরের শিশু শাবাব সহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ডেঙ্গি ওয়ার্ডে হাসপাতালের বিছানায় শিশুর সংখ্যা বেশী। আগস্ট ০৭, ২০২১ তারিখে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে ৯৫৮ জন  ডেঙ্গি রোগী  ভর্তি আছেন।

ডেঙ্গির লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে ঘিঞ্জি এলাকার আবদ্ধ ড্রেনে, পরিত্যক্ত টায়ারে, নির্মাণাধীন বাড়ির জমাট পানি ও অপরিচ্ছন্ন শখের ছাদবাগানের টব ও ড্রামে জমে থাকা পানিতে। ঢাকার মেয়র সাহেবগণ মরিয়া হয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডেঙ্গির লার্ভা খুঁজে হয়রান হচ্ছেন, জরিমানা করছেন। জরিমানার ভয়ে অনেকে বাগান ও নির্মাণাধীন বাড়িতে তালা লাগিয়ে রেখেছেন। তাই লার্ভা থাকার খবর জানালে এখন জরিমানা না করে পরিষ্কার করে দেবার ঘোষণা দেয়ার শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। তবুও বর্ষাকালে ডেঙ্গির লার্ভা জন্মানোর উপকরণ বেশী থাকায় ও বস্তির মানুষ অসচেতন হওয়ায় আরো মাস দুয়েক ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ডেঙ্গি আমাদের সমস্যা শুধু নয়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় সব দেশে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাবের ফলে প্রতিবছর বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু করোনা বৈশ্বিক সমস্যা। সারা দুনিয়ার মানুষ করোনা নিয়ে চরম বিপাকে দিন গুজরান করে চলেছে। করোনার কারণে জরুরি অনেক বিষয় থেকে মানুষ মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিপার্শ্বিক, মানসিক ও দৈহিক সকল বিষয়ে মহা দুর্যোগের ঘনঘটা একসঙ্গে নাড়া দিয়ে মানুষকে বিপর্যস্ত ও বেসামাল করে তুলেছে।

এসকল প্রাকৃতিক মহা দুর্যোগ হলো দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও তাপদাহ, অগ্নিকাণ্ড, বজ্রপাত, বন্যা, ভূমিধ্বস, সাগরডুবি ইত্যাদি। সম্প্রতি চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পদ্মা নদীর তীরে একটি শেডে আশ্রয় নেয়া বরযাত্রীদের ১৭ জন বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন।

এছাড়া মানবসৃষ্ট অনাচার ও সমস্যাগুলো  হলো- সাইবার অপরাধ, নারী পাচার, দেহব্যবসা, মাদকাসক্তি ও মাদক ব্যবসা, ব্যাংক হ্যাকিং, সুন্দরী নারী লেলিয়ে দিয়ে ব্লাকমেইলিং, রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের দ্বারা অবৈধ তদ্বির, জুয়ার ক্যাসিনো, ছিনতাই, চুরি ডাকাতি, ত্রাণচুরি ইত্যাদি তো লেগেই আছে।

বিশ্বের নানা স্থানে যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। আমাদের দেশের সোনার ছেলেরা ধানের দেশ, গানের দেশ ছেড়ে কিসের মোহে দেশ ছেড়ে অবৈধপন্থায় বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ বিসর্জন দিতে কুন্ঠিত হচ্ছে না? গত মাসে ৭০ জন বাংলাদেশী যুবক তিউনিশিয়া সাগরের সীমানায় ডুবে সলিল সমাধি বরণ করেছে। তবুও অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমানো থেমে নেই।

করোনায় সারা পথিবী অশান্ত। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কর্ণারে মানব চলাচলের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। এর লক্ষ্য হলো মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা। অর্থাৎ, মানুষকে করোনায় আর মরতে না দেয়া।

তবে মানুষ দিশেহারা হয়ে কে কখন কী করবে, কীভাবে করবে তার জন্য দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। ইউরোপের মানুষ করোনার মধ্যে মুখোশ-মাস্ক পরতে চায় না। তারা মুখোশ পরার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। রাস্তায় পুলিশের সাথে মারামারি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, পেরু সব জায়গা অশান্ত হয়ে উঠছে।

জাপানের সরকার করোনার মধ্যে নিজেকে জাহির করার জন্য জনরোষকে দাবিয়ে রেখে বিশ্ব অলিম্পিকের আয়োজন করে চলেছে। জাপানের সচেতন নাগরিক এর বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করছে-দাঙ্গা পুলিশের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। অলিম্পিক গেমস্ চলার মধ্যে জাপানে করোনার সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটে চলেছে আমাদের দেশে। সামাজিক অসমতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা ও আয় বৈষম্য প্রকট হওয়ায় আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষেরা দুই বছর পরেও করোনাকে কোন পাত্তাই দিতে চাচ্ছেন না। গ্রামের মানুষ গত বছর করোনাকে কোন রোগ হিসেবে গ্রাহ্য করেনি। তারা ভেবেছিল এটা ধনীদের অসুখ ও সরকারি প্রপাগান্ডা। লকডাউন দিয়ে আমাদেরকে ঢাকা বা ভিন্ জেলায় কাজ করতে যেতে না দেয়ার ফন্দি।

২০২১ সালের মার্চ থেকে যখন গ্রাম-গঞ্জে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু শুরু হয় তখনও তারা উদাসীনছিল। জুন-জুলাইয়ে নিজেরা আক্রান্ত হওয়া শুরু হলে কিছুটা টনক নড়েছে সবার। কিন্তু কুসংস্কার কমেনি।

এখনও তারা টিকা নিতে অনাগ্রহী। আমার পরিচিত গ্রামের বাসিন্দা অনেকে এক সপ্তাহ থেকে সর্দ্দি-জ্বর, কাশি কিন্তু টেষ্ট করাতে বললে অনীহা প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, এটা এমন কিছু নয়। বর্ষাকালে বৃষ্টি-বাদলে একটু কাশি, সর্দি-জ্বর হয়। টেস্ট করিয়ে যদি করোনা ধরা পড়ে তাহলে তার জানাজা দিতে মানুষ আসবে না। সেজন্য টেস্ট না করেই মরা ভাল! আত্মীয়, গ্রামবাসীরা এসে জানাজা পড়বে, মাটি দেবে!  তাই সরকার প্রতি সপ্তাহে এককোটি টিকা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি নিলেও সকল মানুষ টিকা দেবার জন্য প্রস্তুত নয়।

গ্রমের মহিলারা ইঞ্জেকশন নিতে ভয় পায়। তারা বলছেন ভিন্ন কথা- “দাগী (টিকা) দিলে ঘাউয়া (ঘা) হয়, ডানায় দাগ হয়, জ¦র আসে।” এজন্য গ্রামে টিকা দেবার পূর্বে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য উঠান বৈঠক, সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি, ইত্যাদি সম্পন্ন করতে হবে খুব তড়িৎ গতিতে। এ কাজে গ্রামে ঋণদানে কর্মরত জিও, এনজিও কর্মীদের সহায়তা নিয়ে টিকাদানের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা উচিত। কারণ, কোন বাড়িতে শুধু একজনের মাস্ক পরলে বা টিকা নিলে হবে না, গণস্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য সবাইকে গণটিকা দিতে হবে। নাছোড়বান্দা মরণঘাতী করানাকে ঘায়েল করতে ২ ডোজ টিকা নেয়ার ব্যাপারে ধনী-গরিব, ছোট-বড়, বিজ্ঞ-অজ্ঞ সবাইকে সম্পৃক্ত করা খুবই জরুরি।

টিকা নিতে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য উপায় হিসেবে কিছু ইনসেনটিভ-যেমন নগদ অর্থ বা কেন্দ্রে আসা –যাওয়ার রিকশাভাড়া, বাচ্চাদের জন্য লজেন্স, শুকনো খাবার, টি শার্ট, ইত্যাদি উপহার প্রদান করা যেতে পারে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশে ক্ষমতা ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কার্যত: মোটেও বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। ডিজিটাল যুগের দোহাই দিলেও কেন সামান্য কাজের জন্য স্বশরীরে ঢাকায় গিয়ে বার বার ধরনা দিতে হয়? জেলা-উপজেলা থেকে ই-মেইল বা ভিডিও কলে যে কাজ মিনিটেই সম্পন্ন করা যায় তার জন্য কেন ঢাকার সচিবালয়ে বার বার ডেকে পাঠানো হয়- সেটা মোটেও বোধগম্য নয়। হাতের ইশারায় ট্রাফিক আটকালে যেমন লাভ বেশী, বিষয়টা তেমন সেঁকেলে ও সন্দেহজনক মনে হয়। আমাদের দেশে সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক। কর্মক্ষেত্র, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ ও আধুনিকীকরণ হয়নি বলে প্রতিবছর ঈদযত্রায় মানুষের ঢল নামে ঢাকা ছেড়ে বাড়ি যাওয়া-আসা করার ক্ষেত্রে। এবারে করোনার জন্য বার বার লকডাউনের ছুটি ছিল চার-পাঁচটি ঈদের ছুটির মত। তাই এবারে ভোগান্তিটা অনেক বেশী হয়েছে। এখন রাস্তা হয়েছে, ব্রিজ, এয়ারপোর্ট হয়েছে জেলা শহরের পাশে। তাই এখন থেকে সব ধরনের অফিস, কল-কারখানা জেলা শহরে বানানো উচিত। তাহলে ঢাকা নিরিবিলি থাকবে এবং বিভিন্ন উৎসবে বা প্রয়োজনে কর্মজীবি মানুষকে গিনিপিগের মত গিঞ্জি করে চলাচল করতে হবে না।

যেমন জাপানের আলুর চিপসের কারখানা হোক্কাইডো জেলায়, কারণ সেখানে ব্যাপক আলুর আবাদ হয়। আলুর ক্ষেতের পাশেই আলুজাত খাবার তৈরীর কারখানা। তেমনি, মিৎসুবিশি গাড়ির কারখানা মিৎসুবিশি জেলায় ( মিৎসুবিশি অর্থ তিন কাঁটাওয়ালা পানিফল বা সিঙ্গারা এই জেলায় জন্মে সেজন্য এই গাড়ির প্রতীক পানিফলের তিনটি পাতা), ইয়োকোহামা গাড়ি তৈরি হয় ইয়োকোহামা জেলায়। যদিও এসবের বিকেন্দ্রীকরণ তারা বিদেশেও করেছে। গবাদি পশুর ফার্ম ও মাংস প্রসেস কারখানা কুমামোতো জেলায়। এভাবে সব কিছুর বিকেন্দ্রকরণ করায় তাদের উৎপাদন খরচ কম এবং গাড়ির দেশ হওয়া সত্ত্বেও চলাচলের পথে আমাদের মত যন্ত্রণাদায়ক ট্রাফিক জ্যাম নেই।

আমরা এসব জানি। কিন্তু জেনেশুনেও ঢাকাতেই সবকিছুর ভাগাড় বানিয়ে ঢাকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত করে ফেলেছি। সুতরাং দেশে কোথাও করোনা বেড়ে গেলে বা বড় সমস্যা হলে তার ঢেউ ঢাকায়  এসে আছড়ে পড়বেই। আমরা চাইনা কর্মজীবি বিপুল মানুষের আসা-যাওয়ার অবহেলা ও কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতার কারণে সবকিছু আরো নিয়ন্ত্রণহীণ হয়ে পড়ুক। করোনা সংক্রমণের উর্দ্ধগতির সময়ে লকডাউনের মধ্যে কারখানা খোলার খেসারত দিতে গিয়ে ঢাকার ঢিলেঢালা ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গি, যানজট ও সার্বিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ুক এবং ব্যাপক প্রাণহানিতে  সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ওলট-পালট হয়ে জীবন-ব্যবস্থা চরম বেসামাল হোক- এমনটা আমরা চাই না। যেমনটা আবার শুরু হয়েছে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত,  ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায়।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সাবেক চেয়ারম্যান E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর