অথঃ ভাঁড় সমাচার!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 11:26:27

গোপাল ভাঁড়, বীরবল, মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা কিংবা দোঁ-পেয়াজির নাম শুনলেই সবার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসির দেখা পাওয়া যায়। বুদ্ধিদীপ্ত কথা ও কৌশল দিয়ে ভাঁড়েরা কর্তা ও কর্তৃপক্ষের মনোরঞ্জন করতেন। রস-রসিকতা, নির্মল হাসি ও উপদেশমূলক কাহিনীর মধ্যে তারা ইতিহাসের পরম্পরায় এখনও অব্দি জীবন্ত রয়েছেন। হাসি-ঠাট্টা-কৌতুকের ভেতর দিয়ে ভাঁড়গণ ব্যক্তিগত দক্ষতা ও প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন; তৈল মর্দন করে চাটুকারিতা করেন নি।

বিশেষ করে মধ্যযুগের ইতিহাসে সমাজ ও রাজদরবারে ভাঁড়দের আনাগোনার কথা উল্লেখযোগ্যভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রাচীন আমলে ভাঁড় ছিল না, এমন নয়। হয়ত ছিল। অন্য নামে। যেমন, আজকের অতি আধুনিক ও অগ্রসর কালেও ভাঁড়ের দেখা পাওয়া যায়। যদিও একালের ভাঁড়গণ নিজেদের আজকাল ভাঁড় বলতে নারাজ। কিংবা তারা ভাঁড়ের আসল পরিচয় অন্য পরিচয়ের আলখাল্লা দিয়ে আড়াল করে চলতে অভ্যস্ত। তথাপি ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়’-এর মতো বর্তমান সমাজে ক্রিয়াশীল ও বিদ্যমান ভাঁড়-পদবাচ্যদের কাজ-কারবার দেখে ও কথা-বার্তা শুনে দিব্যি চিনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে নামে-বেনামে-পদে-পদবিতে ঘুরে বেড়ালেও মানুষ যথারীতি তাকে শনাক্ত করে বলে দিচ্ছে, ‘আরে! ও তো আস্ত একটি ভাঁড়’।

হাল-আমলে অবশ্য আরেকটি সমস্যা হয়েছে। সমাজ ও মানুষের ধারাবাহিক অগ্রগতি ও উৎকর্ষতার সুবাদে প্রাচীন ভাঁড়ের বিশুদ্ধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নির্মম আনন্দদানকারীর সংখ্যা কমে গিয়ে বাড়ছে ধান্ধাবাজ তৈলমর্দনকারীর। ক্ষমতার পদপৃষ্ঠে সাষ্টাঙ্গে লেপ্টে থেকে এই শ্রেণি আকছার তেল দিয়ে নিজের সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। চারিত্রিক দিক দিয়ে প্রাচীন ভাঁড়গণ কিন্তু এতটা নিম্নস্তরের ছিলেন না।

সে যাই হোক, মধ্যযুগে ভাঁড়দের উত্থানকালের ইতিহাসের নিরিখে জানা যায় যে, শুধু রাজসভায় নয়, রাণী এবং রাজকন্যারাও নিজস্ব বিনোদনের জন্য মহিলা ভাঁড় পুষতেন। গবেষকরা এ-ও জানাচ্ছেন যে, ইতিহাসের নানা সময়ে রকমফের অনুযায়ী ভাঁড়দের দশটি ভাগ ছিল। কাজের তারতম্যের ভিত্তিতে এমন ভাগ করা হলেও সকল ভাঁড়ের প্রধান ও একমাত্র কাজ ছিল হাসি-আনন্দের সঞ্চার করা। বলাই বাহুল্য, সে আমলে বিনোদনের যান্ত্রিক ও অত্যাধুনিক মাধ্যমের উদ্ভব না হওয়ায় রাজা-বাদশাহরা শিকার, মল্লযুদ্ধ, ভাঁড়ের কৌতুকের মাধ্যমে বিনোদিত হতেন।

ভাঁড় প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সংস্কৃত সাহিত্যে একটি চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়, যার নাম ‘বিদূষক’। ভাঁড়দের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যই এদের মধ্যে দেখা যায়। নাট্যশাস্ত্রেও বিদূষকদের কথা আছে। তাতে চার রকমের বিদূষকের উল্লেখ রয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েকজন ভাঁড় ঐতিহাসিক চরিত্রের গুরুত্ব পেয়েছেন। এদের একজন বীরবল। বীরবল কেবল ভাঁড় বা রসিকই ছিলেন না, ছিলেন সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতিও। ছিলেন আকবরের পরামর্শদাতা ও বন্ধু। অনেকগুলো মুঘল চিত্রকলায় আকবরের পাশেই বীরবলের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তিনি রাজদরবারে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তদুপরি আবুল ফজল এবং আবদুল কাদির বাদাউনির লেখা থেকেও বীরবল সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, ভাঁড় বা বিদূষক হলেও বীরবল মোটেও উপেক্ষিত বা হাস্যস্পদ ছিলেন না।

কম আলোচিত হলেও দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের দরবারে ভেঙ্কটরাও তেনালিরাম নামের একজন ভাঁড়ের কথা ইতিহাসে রয়েছে, যিনি তেলেগু ভাষার বিখ্যাত কবি ছিলেন। সমাজ ও ইতিহাসে রসিকতার মধ্যে দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা ও শিক্ষণীয় বিষয় তিনি উপহার দিয়েছেন। সস্তা কৌতুল বা তেল-মারা দিয়ে তিনি ইতিহাসের স্থান পান নি; পেয়েছেন গঠনমূলক কাজ ও বক্তব্যের মাধ্যমে।

একই কথা পৃথিবীর নামজাদা ভাঁড়দের সম্পর্কে বলা যায়। যারা তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে হাসির খোরাক যেমন দিয়েছেন, সঠিক পথ ও নীতির দিশাও দিয়েছেন। তুর্কিস্থানের মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা কিংবা অখণ্ড বাংলার গোপাল ভাঁড়ের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

বিশেষ করে বাংলার কৃষ্ণনগর রাজদরবারের গোপাল ছোট-বড় সকলের প্রিয় ছিলেন। রাজা থেকে প্রজা, সবাইকেই হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন তিনি। তার বুদ্ধির দীপ্তি ও আচরণের চমৎকারিত্বে মোহিত হয়েছিল সবাই।

কিন্তু এই গোপাল আসলে ছিলেন নাকি কাল্পনিক চরিত্র তা নিয়ে ধন্ধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, গোপাল আসলে নাপিত বা নরসুন্দর জাতির মানুষ। নিজের বুদ্ধিমত্তায় রাজাকে আমোদিত করে তিনি রাজদরবারে ঠাঁই পেয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণনগর রাজদরবারের রাজকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তার রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল'-এ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সকল বিদগ্ধজনের কথা লিখেছেন। কিন্তু গোপাল বলে কোনও ভাঁড়ের উল্লেখ সেখানে নেই। তথাপি লোকমুখে প্রচলিত রস-উদ্দীপক গল্পকথায় গোপাল ভাঁড় আজও জীবন্ত চরিত্র হয়ে আছেন।

গোপাল ভাঁড়, বীরবল, মোল্লা দোঁ-পিয়াজি, মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, গণু ঝা, খত্তর কাকা, তেনালিরাম, শেখ চিল্লি, বব্বন হাজ্জাম ইত্যাদি অনেক নামজাদা ভাঁড়ের নাম ইতিহাসের বইপত্রে এবং লোককথায় ছড়িয়ে রয়েছে, যারা তাদের হাস্যরস, কৌতুক, চাতুর্য্য দিয়ে তাদের সমকালের মানুষদের মাতিয়ে ছিলেন। বিশ্বখ্যাত বহু রাজা-বাদশাহ ও রাজবংশের ইতিহাসের পাশাপাশি স্বীয় কর্ম, মেধা ও যোগ্যতায় এইসব ভাঁড় বা বিদূষকরাও ঐতিহাসিক গুরুত্ব পেয়েছেন। নিজেদের নাম ও কীর্তি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন ইতিহাসের পাতায় এবং লোকশ্রুতিতে।

ভাঁড় সম্পর্কে এই সামান্য তথ্যই যথেষ্ট নয়। আরও বিষদে যারা জানতে চান, তারা সাম্পান চক্রবর্তী নামক এক গবেষকের ‘লোকজীবন ও অবসরের ভাঁড়’ নামক গ্রন্থটি পড়তে পারেন, যেটি প্রকাশ করেছে কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স।

এই তো গেলো প্রাচীন ও সমৃদ্ধ এতিহ্যের অধিকারী অভিজাত ভাঁড়দের কথা। কিন্তু একালের ভাঁড় বা বিদূষকদের কথা কে জানবে বা মনে রাখবে? আত্মস্বার্থে প্রভুর শরীরে তৈলমর্দন ও পদলেহন করে করে তারা যে বিলীন হয়ে গেছেন। ভাঁড় নামক লোকপ্রিয় একটি পেশার ঐতিহ্য ধরে রাখার যোগ্যতাও একালের ভাঁড়গণ দেখাতে পারেন নি। আজকের এহেন চাটুকার ও অযোগ্যরা হয়ে আছেন ভাঁড় নামধারী রসময় ঐতিহাসিক শ্রেণিটির কলঙ্কস্বরূপ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর