মাদক জিন-পরী ডেঙ্গু করোনা- আর শুনতে ভাল্লাগেনা

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-20 13:42:53

এত ভাল জিনিষ থাকতে খারপ জিনিষগুলো আগেভাগে ঢাকায় ঢুকে যায় কেন? কীভাবে? কারণ, মানুষ সর্বাগ্রে ঢাকায় ঢুকে, বেড়াতে আসে, চিকিৎসায় আসে, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা এমনকি বিদেশ যাত্রা করতে গেলেও ঢাকায় প্রবেশ করতে হয়। হয় আগে। রাস্তায় চলার জায়গা আঁটে না তবুও গাড়ি কিনে। গাড়ি চলে না, তবুও বসে বসে তেল পুড়িয়ে গন্তব্যে যাবার জন্য অপেক্ষা করে। ওদের কত ধৈর্য্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে বসে সময় কাটানো নিত্য দিনের রুটিন ওয়ার্ক ঢাকার মানুষের। গাড়িতে এসি চলে, সরকারি তেল ফুরায় তাতে কার কী যায় আসে? সরকারী গাড়িগুলোর এসি খুলে দিলে কেমন হয়? তাহলে আর কেউ রাস্তায় বসে থাকতে চাইবে না, গরমের জ্বালায় নেমে হাঁটা দেবে। বড় একটি গণ পরিবহনের নন এসি বাসের সিটে বসে বাবাকে জিজ্ঞেস করছিল এসব নানা প্রশ্ন- ছোট্ট নিলয়। এক গ্রামের স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে সে। প্রথম এসেছে ঢাকায়। ভাল গান গায়। টিভিতে একটি গানের প্রতিযোগিতায় গ্রাম পর্যায়ে প্রথম হয়ে ঢাকায় আসার ডাক পেয়ে সে খুশিতে চলে এসেছে স্কুল শিক্ষক বাবার সাথে।

মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে ওরা। তারপর গন্তব্যে যাবার জন্য রাস্তায় নেমে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করে না পেয়ে অবশেষে একটি পুরনো বড় বাসে ভিড় ঠেলে উঠে পড়েছে। কারওয়ান বাজার যাবে মিরপুর থেকে। এই রুটে বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম তার।

কিছুক্ষণ পর পর বাসটি থেমে যায়, নড়ে না। প্রথম প্রথম তার ভাল লেগেছে পাশের বড় বড় বিল্ডিং ও চারদিকের ছোট ছোট গাড়িগুলো দেখে। নানা রঙের নানা সাইজের এত কার সে আগে কখনও দেখেনি। এত পিপ্ পিপ্ও শুনেনি। বাসের জানালা খোলা। তাই পোড়া মবিল-পেট্রোলের গন্ধ ভালই লাগছে তার।

দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। আর তো মাত্র আধ ঘণ্টা আছে। এখনও মিরপুর এক নম্বরে বাস দাড়িয়ে। সর্বনাশ। সময়মত পৌঁছাতে পারবো তো? ওর বাবা বিড়বিড় করে বলছেন আর ঘেমে যাচ্ছেন। বাবার চিন্তা দেখে ওর মনেও চিন্তা ঢুকে গেল। সেও ঢাকার রাস্তার দৃশ্য দেখার কৌতুহল ভুলে ঘামতে থাকলো। বাসে ভীষণ ঠেলাঠেলি। মানুষ গায়ের উপর চেপে উঠে যাচ্ছে আর নামছে। লকডাউনের ফলে রাস্তায় বাস কম চলছে। তাই মানুষের ভিড় অসহ্য। গরমে ও তেল পোড়া গন্ধে ওর মাথা ঘুরতে লাগলো। একসময় সামলাতে না পেরে ভক্ করে বমি করে দিল।

যাত্রীরা চিৎকার করে উঠলো ওকে নামিয়ে দিন। গায়ে জ্বর নিয়ে গাড়িতে উঠছে কি-না কে জানে। করোনা ও ডেঙ্গির ভয়ে সবাই আতঙ্কগ্রস্থ থাকে সব সময়। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে সবাই তার দিকে কটমট করে তাকায়। ও জানে ও সুস্থ। শুধু বাসের ঘিঞ্জি পরিবেশ ও চাপাচাপিতে ওর বমনেচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? গাড়ি যে নড়ে না, সামনে যায় না। রিহার্সেলে অংশ নেয়া হবে না। যে গানটি গেয়ে গ্রাম থেকে সে ফার্স্ট হয়ে ঢাকায় এসছে সেটা হলো- ‘গাড়ি চলে না...”। এখন উপলব্ধি করছে সেই গানের মর্মার্থ।

সেদিন ইটিভি অফিসে সময়মত তার পৌঁছানো হয়নি। তবে তার প্রতি দয়া পরবেশ হয়ে পরদিন সকাল ৯ টায় আসতে বলা হয়েছে পুনরায়।

সেদিনে ঘরে ফিরে তার প্রিয় মামাতো ভাই শাবাবের সাথে নানা কথা হলো তার। শাবাব হাই স্কুলে উঠেছে। স্কুল বন্ধ থাকায় সারাদিন ঘরে বসে টিভি দেখে আর ইন্টারনেটে গম খেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। এখন অনলাইন ক্লাস শেষ হয়েছে। সে নিলয়কে পেয়ে খুব খুশি। তবে এই ভয়ের কথাটাও জানালো যে এখন দেশের অবস্থা খুব খারাপ। ঢাকায় করোনার সাথে ডেঙ্গুও দেখা দিয়েছে। এ সময় তোমাদের ঢাকায় আসা উচিত হয়নি। কেন যে টিভিওয়ালারা এই খারাপ সময় এসবের আয়োজন করলো?

করোনার তীব্র সংক্রমণের মধ্যে বার বার লকডাউন দেয়ায় শ্রমজীবী মানুষ পেটের দায়ে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটতে শুরু করলো। একবার নয় কয়েকবার। সাথে দুটো ঈদের ছুটির মধ্যেও এই অবস্থা তৈরি হলো। করোনারভাইরাস মাখামাখি করে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিয়ে এলো। আবার সীমান্তের গ্রাম থেকে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সাথে করে ঢাকায় নিয়ে এলো।

তুমি তো জানো যে বর্ষাকালে ঢাকায় প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এবারে বেড়ে গেছে অনেক বেশী হারে। রাজধানীর আশেপাশে হাজার হাজার নির্মাণ কাজ চলছে। সেসব কাজের মালিক-শ্রমিক কেউই সচেতন নন। নির্মাণাধীন দালানের পানি নিষ্কাশণের তেমন ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশণেরও তেমন সুব্যবস্থা নেই। বহু এলাকায় রাস্তায় গড়িয়ে জমা হয়ে থাকে সেসব পানি। এছাড়া সবাই তৈরি করেছে শখের ছাদবাগান। ছাদের মধ্যে বড় বড় ড্রামে ফলের গাছ লাগানো হচ্ছে। গাড়ির টায়ারের রিং ঝুলিয়ে ড্রাগন ফলের চাষ করা হচ্ছে ছাদে। যেগুলোতে বৃষ্টির পানি ঢুকে জমা হয়ে থাকে। ছাদকৃষির বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করে না অনেক বাগান মালিক। আরো নানা কারণে বাগানে ডেঙ্গুর বংশবৃদ্ধি হচ্ছে।

এসব কথা বলতে বলতে টিভি দেখছিল দুজন। সেসময় কিছু জনপ্রিয় নায়িকাকে গ্রেফতার করে টিভিতে সংবাদ সম্মেলন করছিল আইনশৃংখলা বাহিনীর কালো পোশাক পরা একদল সদস্য। তারা অনেক বিদেশি মদের বোতল, ইয়াবা বড়ি সাজিয়ে সেগুলো উদ্ধার করেছে বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। নিলয় প্রশ্ন করলো, ওরা তো সবাই মুসলিম তাহলে ওদের বাসায় এত বিদেশি মদের বোতল কেন? এত সুন্দর সুন্দর বোতল। কে খায় ওগুলো? শাবাব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বলতে লাগলো কিছুক্ষণ আগে সে একটি টকশোতে একজনকে বলতে শুনেছে যে, দেশে করোনা ও ডেঙ্গুর ভয়াল অবস্থা আড়াল করতে এখন নায়িকাকে বাসায় মদের বোতল উদ্ধার করে মানুষের মনোযোগ ভিন্নদিকে আকর্ষণ করার এটা পুরাতন কৌশল। তা সবাই বোঝে। তবুও কেন যে বিপদের সময় ওরা সত্যিটাকে স্বীকার করতে এত চালাকি করে-তা তুমি এত তাড়াতাড়ি বুঝবে না ভাই।

আমাদের দেশে মাদক খাদকের সংখ্যা বড্ড বেড়ে গেছে। তবে মাদকসেবীদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দেশের অনেক হোমরা চোমড়া ব্যক্তিরা মাদক না খেলে থাকতে পারেন না। বড় বড় হোটেলে ওদের জন্য বার আছে। অনেকের বাসাতেই মিনি বারে নিয়মিত মদের আসর বসে। করোনার সময় ইন্টারনেটে দামি মাদকের কেনা বেচা চলছে। ধনীর ছেলেরা ধরাও পড়েছে। মাদক ব্যবসা অনেক সহজ ও লোভনীয় ব্যবসা। এত দ্রুত ধনী হওয়া যায়। মাদকের বড় বাজার এই রাজধানী শহর। শাবাব গণমাধ্যমে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। তাই গ্রামের ছোট ভাইটিকে পেয়ে নিজের জ্ঞান জাহির করতে থাকলো।

সে আরো বলতে লাগলো- মাদকের আসল জিন, আসল পরী আছে। আছে মাদক-জিনের বাদশাহ্, মাদক-পরীর রানী। তাদেরকে কেউ ধরে না। তাদেরকে অনেকে সমীহ করে সালাম দেয়, বখশিশ নেয়। তারা ছিঁচকেদের কান ধরে আর বড় মাদক-খাদক ও ব্যবসায়ীদের আড়ালীকরণের নির্দেশ পালন করতে তৎপর থাকে। তবে এখন এসব নিয়ন্ত্রণে কিছু ভাল মানুষ দেখা যাচ্ছে। তারা একটু আন্তরিক হলে জি¦ন-পরীদের বাদশা-বেগমদের ফুৎকার দিয়ে দেশছাড়া করে সাত সমুদ্র তের নদী পার করে ভাগিয়ে দিতে পারে।

এতসব শুনতে শুনতে নিলয় হাই তুলতে থাকলো। সারাদিন বাসে যাওয়া-আসা করে ঘামে ভিজে তার শরীর অবসন্ন। এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে। সে বলল, ভাইয়া এখন আর  মাদক, জিন-পরী, ডেঙ্গি, ফেঙ্গি, করোনার কথা বলোনা তো। আজ রাতে আর কিছু শুনতে ভাল্লাগছেনা। আগামীকাল সকালে গান গাইতে যেতে হবে। বাসায় ফিরে কাল রাতে বাকিটা শুনবো।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর