প্রবাসীদের অবদান সরকার ভুলে যায়নি

, যুক্তিতর্ক

মো. মাজেদুল হক | 2023-08-30 15:44:56

বাংলাদেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৪৬ বিলিয়ন ডলারের উপর। এর মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২০২১  অর্থবছরে ফরেন রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু মরণব্যাধী করোনাভাইরাস প্রবাসীদের জীবন-জীবিকার উপর আঘাত হেনেছে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা রাতারাতি কর্মহীন হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরে এসেছে। অনেকে বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের স্বজনদের কান্না এখনো থামানো যায়নি। এ কান্না কখনো থামবে না।

করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর এ পর্যন্ত ৫ লাখের কাছাকাছি প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলোতে যারা আর্থিক ভাগ্যে পরিবর্তনের আশায় কর্মরত ছিল, তারাই বেশিরভাগ দেশে ফিরে এসেছে। তার কারণ হলো যে, করোনাভাইরাস দেখা দেওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যায়। তেল-নির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতির গতি রাতারাতি থেমে যায়। বাধ্য হয়ে নিয়োগকারীরা কর্মীদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় এবং সেই সাথে ছাটাই কার্যক্রম চালাতে থাকে। কোন উপায় না দেখে প্রবাসীরা বাংলাদেশে ফিরতে শুরু করে। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তারা আরোও বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। না আছে কাজ, না আছে উপার্জন । তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন শুরু করে। তাদের পাশে দাঁড়ানো মতো কেউ নাই। ১৯৭৬ সাল থেকে এ দেশের অর্থনীতিতে তারা যে অবদান রেখে চলেছে তা আমরা ভূলে গেছি।  তাদের পাঠানো কষ্টার্জিত ডলার দিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক নিয়ে আমরা এখন গর্ব করি। এ গর্বের পেছনে রয়েছে দক্ষ-অদ্ক্ষ প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান।

ফেরত আসা প্রায় ৫ লাখ শ্রমিকের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভেবে  বর্তমান সরকার অতি সম্প্রতি তাদের জন্য ৪ শত ২৭ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। প্রথমে ২ লাখ ফেরত আসা প্রবাসীদের প্রত্যেককে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে  প্রদান করা হবে। ধীরে ধীরে সবাইকে এ প্রকল্পের আওতায় এনে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা হবে।

উল্লেখ্য,  এ প্রকল্পের আওতায় ৩২ জেলাকে নির্বাচন করা হয়েছে যা ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। মূলত বাংলাদেশে বসবাসরত ফেরত আসা প্রবাসীদের উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য সরকার এ ধরনের সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এছাড়াও সরকার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ২৩ হাজার ৫০০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মাঝে সনদ প্রদান করবে যারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয়। দুঃখজনক যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য মোট ৭০১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিগত অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৩৮ কোটি টাকা। এত কম বরাদ্দ দিয়ে প্রবাসীদের অবদান ধারন করা লজ্জাজনক। এই মুহুর্তে প্রবাসীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে না পারলে এবং সেই সাথে যদি করোনার টিকা নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ফরেন রেমিট্যান্সের প্রবাহের গতি থেমে যাবে। তবে বরাদ্দকৃত বাজেট দিয়ে এই মহামারীর সময় প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। করোনা মহামরীর মধ্যে অভিবাসন খরচ বেড়ে গেছে ২৩ শতাংশ যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বলা দরকার যে, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রাক্কলন করা  হয়েছে। করোনাভাইরাসের কথা মাথায় রেখে এ প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু, হঠাৎ করে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণ বেড়ে যাবে তা কখনোও ভাবা যায়নি। সরকার ফেরত আসা মহিলা প্রবাসীদের জন্য ৬০ মিলিয়ন টাকার যে ইন্ট্রিগেশন প্রজেক্ট চালু করেছে তা সফল নাও হতে পারে। কারন, এ প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক মহিলা প্রবাসী শ্রমিক পাবে মাত্র ৩০০০ টাকা করে। এ সামান্য অর্থ দিয়ে কি উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব? আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি যে, এ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৬০ এর পরিবর্তে  ১৫০ মিলিয়ন করার জন্য।

আমার প্রশ্ন যে, প্রবাসী কল্যাাণ ব্যাংক কি আদৌও প্রবাসীদের কল্যানের জন্য কাজ করতে পারছে? বিগত এক দশকে ৫৬ লাখ শ্রমিক কাজের সন্ধানে  বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৯ হাজার প্রবাসীদেও ঋণ দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক অর্থাৎ গত এক দশকে এ ব্যাংক মাত্র ৬১৯ কোটি টাকা ঋন প্রদান করেছে। আমি বলতে চাই এ ব্যাংকের ৬১টি শাখা দিয়ে প্রবাসীদেও কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে না। প্রয়োজন হলে সরকার পরিচালিত অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসীদের জন্য ঋণ কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।  আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ধন্যবাদ জানাই উনার প্রবাসীদের প্রতি ভালবাসা দেখে। উনি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের কথা ভূলে যাননি। সম্প্রতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংক-  প্রেরিত রেমিট্যান্সের উপর ৩ শতাংশ হারে  প্রনোদনা দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন ২ শতাংশ হারে দেওয়া হয়। আমার বিশ্বাস যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীরা আর্থিক এবং মানবিক সমর্থন পেলে এ দেশ অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে প্রবাসীরা।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক।      

এ সম্পর্কিত আরও খবর