আফগান পরিস্থিতি ও আমেরিকা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 20:59:54

২০ বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচের মার্কিন প্রচেষ্টা সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে আফগানিস্তানে। মার্কিন মদদপুষ্ট আফগান সেনাবাহিনী তালেবানদের সামনে টিকতে পারেনি। সামরিক ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ব্যর্থতার চিত্রও প্রকট হয়েছে তখনই, যখন বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে খোদ প্রেসিডেন্ট এবং প্রায়-সকল নেতৃত্ব নিমেষে পালিয়ে গেছেন। ফলে বিনা-বাধায়, বিনা-প্রতিরোধে, রক্তপাত ও সংঘর্ষ ছাড়াই তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলে সক্ষম হয়।

১৯৭৯ সালের পর ৪২ বছর এবং এর মধ্যে আমেরিকার কর্তৃত্বকালীন ২০ বছরে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো দূরের কথা, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনও সম্পন্ন হয়নি। ফলে সরকারের সঙ্গে জনগণের নূন্যতম সম্পর্ক ও সংযোগ ছিল না। চাপিয়ে দেওয়া সরকার তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে এবং তাদের মাথায় অযোগ্যতা, অদক্ষতার পাশাপাশি রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ।

আফগানিস্তানের একটিও সরকার সঠিক ভাবে নির্বাচিত না হওয়ায় দেশটি শাসনকারী কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও বৈধতা ছিল না। সব সময়ই সারা বিশ্বের মতো আফগানিস্তানের সিংহভাগ মানুষ সরকারকে 'দখলদার' ও 'আমেরিকার পুতুল' মনে করেছে। ফলে মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া আপামর আফগান জনতা তালেবানদের আক্রমণের মুখে সরকারের পাশে দাঁড়ায় নি।

আগের কারজাই সরকারের মতো সদ্য-পতিত আশরাফ গনি সরকারকেও আমেরিকা বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতার আসনে বসিয়েছিল। এ নিয়ে আমেরিকার প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল আফগানবাসীর মধ্যে। মানুষেরা তালেবানকে চাইতেন না ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি আমেরিকাকেও পছন্দ করতেন না। কেন এতো টাকা ঢালার পরেও আমেরিকানদের পছন্দ করেনি আফগানরা?

তার কারণ, আফগানিস্তান জুড়ে আমেরিকার ক্রমাগত অত্যাচার। রেডক্রসের হাসপাতালও ধ্বংস হয়েছে আমেরিকার হামলায়। অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে আমেরিকার যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে। যে ঘটনাগুলো কখনওই মানুষ ভুলতে পারেনি। তীব্র ঘৃণায় মনে রেখেছে।

মানুষের কষ্ট, দুর্ভোগ ও ক্ষোভকে প্রাধান্য না দেওয়ার প্রতিফল ভালো হয় নি।আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসে মজা লুটতে থাকা সরকার এই সমস্যাগুলোকে কখনও সমাধানের চেষ্টা করেনি। করবেই বা কী করে! কারণ ওদের হাত-পা ছিল বাঁধা। আমেরিকার টাকায় ওরা ক্ষমতায় বসে আছে। সেই ক্ষমতায় থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যাওয়া তো সম্ভব নয়। হামিদ কারজাই তাঁর শাসনকালের শেষের দিকে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উল্টে তাঁকেই সরে যেতে হয়েছে।

আসলে আমেরিকার হাতে তৈরি পরিস্থিতিই ধীরে ধীরে তালেবানের দিকে হাওয়া ঘুরিয়ে দেয়। খুব ধীরে হলেও তা ক্রমে আমেরিকার বিরুদ্ধে গোটা আফগানিস্তানকে তাতিয়ে তোলে। তালেবানের মধ্যে একটা ‘বিপ্লবী’ সুলভ ভাবভঙ্গি আছে, আমেরিকার অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষ মুক্তির লক্ষ্যে সেটা আরও বেশি করে মেনে নিতে শুরু করে।

অন্যদিকে, মার্কিন মদদ পাওয়া সরকার নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে না পেরে উপরে উপরে মার্কিন তাঁবেদারি আর গোপনে লুটপাট ও দুর্নীতি করেছে। পলাতক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির সঙ্গে থাকা বস্তা বস্তা টাকা সে প্রমাণবহ। সর্বোচ্চ স্তরের মতো প্রায়-সকল পর্যায়ের লোকজনই দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা কামিয়েছে।

সামরিক ও রাজনৈতিক দিকের মতো কূটনৈতিক দিক থেকেও আমেরিকা চরমভাবে পরাজিত হয়েছে আফগানিস্তানে। চীন যেখানে যুদ্ধ করে নয়, কূটনৈতিকভাবে এগিয়েছে এবং সফলতাও পেয়েছে আফগানিস্তানের বিষয়ে, আমেরিকা তা পারেনি। শুধু চীন নয়, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান, পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও সংলাপের সম্পর্ক বজায় রেখেছে। বরং তালেবানকে তলে তলে সাহায্য করে আমেরিকাকে শায়েস্তা করার মওকা কাজে লাগিয়েছে। পক্ষান্তরে, তালেবানদের জন্য দরজা বন্ধ করে আমেরিকা লাগাতার যুদ্ধ করে সীমাহীন পরাজয় বরণ করছে।

ফলে ১৯৯৪ সালে পাহাড়ি কান্দাহারে প্রতিষ্ঠিত তালেবানরা মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর যেমন ক্ষমতায় ছিল, তেমনি ২০ বছর লড়াই করে ২০২১ সালে আবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। ইতিহাসে এই ঘটনা যত না তালেবান বিজয় বলে উল্লেখ্যযোগ্য হবে, আমেরিকার জন্য তারচেয়ে বেশি চিহ্নিত হবে ভিয়েতনামের মতো আরেক ঐতিহাসিক পরাজয় রূপে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর