‌সমাজে শ্রেণি বৈষম্য: জমিদারি ও দাসপ্রথার পুনরাবৃত্তি

, যুক্তিতর্ক

মোঃ আকিক তানজিল জিহান | 2023-09-01 21:03:58

সমাজের শ্রেণি বৈষম্যের চলমান ধারায় বিত্তশালী হয়েছে আরও বিত্ত, গরীব হয়েছে ক্ষুধার্ত। এক কথায় কেউ থাকে রাজহালে, কেউ পড়ে অন্ধকারে। উচ্চবিত্ত শ্রেণি খাবার গ্রহণের জন্য যায় হোটেল-রেস্তোরাঁয়, এদিকে নিম্নবিত্তের জোটে না রাস্তায় ফেলে দেওয়া অন্নটুকুও। কেউ কোটপ্যান্ট পড়ে এয়ার কন্ডিশনার গাড়িতে চড়ে বের হয় লোক দেখানোর জন্য আর অন্যদিকে বস্ত্রহীন মানুষের জীবিকার তাগিদে অন্তহীন ছুটে চলা। কেউ থাকে উঁচু দালানকোঠায় আর কারও জায়গা হয় না রাস্তার ধারে। আরও যে কত কি!

প্রাচীন সমাজ আধুনিক হয়েছে ঠিকই কিন্তু কমেনি নিম্নবিত্ত মানুষের আর্তনাদ। আবদ্ধ শৃঙ্খলের মাঝে এক প্রকার ব্যর্থ তারা জীবনের তাগিদ মেটাতে। অর্থ-প্রাচুর্য নির্ভর গড়ে ওঠা সমাজ ব্যবস্থার যাঁতাকলে প্রতিনিয়তই পিষ্ট হচ্ছে তাদের এক একটি স্বপ্ন। শূন্য এ ভুবনে তাদের আর্তনাদ শোনার মত কোথাও কেউ নেই, চারিদিকে শুধু তাদেরই হাহাকার ভেসে বেড়ায়। এখনও তারা সামান্য ভরণপোষণের জন্য সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির করুণার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এদিকে উচ্চবিত্তের কতোই না রূপ আর সজ্জা।

আজ বিশ্বের প্রতিটি স্তরে অসমতা দানা বেঁধেছে প্রবলভাবে। নিম্নবিত্ত মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অপরদিকে উচ্চবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। সমাজে শ্রেণি বৈষম্যের এই করুণ অবস্থা প্রকোপ আকার ধারণ করেছে।

গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ গবেষণা অনুসারে, ২০১৯ সাথে বৈশ্বিক সাক্ষরতার হার ছিল ৮৬.৪৮ শতাংশ। যা ১৯৭৬ সালের দিকে ছিলো ৬৬.৯২ শতাংশ। তবে এখনও অনেক দেশেরই শিক্ষার হার ৫০ শতাংশের নিচে। এমনকি কিছু দেশে শিক্ষার হার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক গণসাক্ষরতা কর্মসূচির শোনা গেলেও সত্যিই কি সর্বজনীন শিক্ষার বিষয় পূরণ করা সম্ভব হয়েছে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। একইসাথে কর্মমুখী শিক্ষার শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়নি বললেই চলে। একইভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে আধুনিকায়ন হয়েছে ঠিকই, তবে বৈষম্যভেদি চিকিৎসা সেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

২০২১ সালে সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন কতৃক প্রকাশিত ৮৯টি দেশ নিয়ে করা এক জরিপে দেখা যায় যে, স্বাস্থ্যসেবা সূচকের ১০০টির মধ্যে ৭৮.৭২ স্কোর করে তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। অপরদিকে, ৩৩.৪২ স্কোর নিয়ে ভেনিজুয়েলার অবস্থান তলানিতে।

এদিকে এ বছরে ওইসিডি কতৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ বৈশ্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৬.৬ শতাংশ, যা ১৯৯১ সালে ছিল ৪.৮ শতাংশ। অর্থাৎ, এটি স্পষ্টতই যে গত তিন দশকের ব্যবধানে বেকারত্ব বেড়েছে ১.৮ শতাংশ। অক্সফামের ধারণা করোনা মহামারির ফলে ২০২০ সালে অধিক মাত্রায় ক্ষুধায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৭০ মিলিয়ন। বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে ১৯৯০ সালের থেকে ১.২ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছে। একইসাথে প্রতিদিন ১.৯০ ডলারেরও কম নিয়ে টিকে থাকা মানুষের সংখ্যা ৭৮০ মিলিয়ন। আরও অনুমান করা হয়েছে যে, মহামারি পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে অতিরিক্ত ৮৮ মিলিয়ন থেকে ১১৫ মিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে এবং ২০২১ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫০ মিলিয়নে।

অপরদিকে, ২০২১ সালে ফোর্বসের রেকর্ড অনুযায়ী প্রতি মিলিয়নে ০.৩৫ হারে ৭০টি দেশের বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা মাত্র ২৭৫৫ জন। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং স্পষ্টতই শ্রেণি বৈষম্যকে নির্দেশ করে।

কয়েক শতক আগেই জমিদারি প্রথা, দাস প্রথার মত বিষয়গুলো সমাজে সর্বজন স্বীকৃত ছিল। ঐ সময় জমির মালিক তাদের মর্জি অনুসারে কৃষকের উৎপাদিত ফসলজাত পণ্যের উপর কর্তৃত করত। একইসাথে হাট-বাজারে পণ্যের ন্যায় দাস হিসেবে মানুষ কেনাবেচা হতো। আর এই গোড়া সমাজ থেকে মানুষের মুক্তি লক্ষ্যেই পালাক্রমে চারটি শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে ঠিকই তবে এর দরুণ প্রভাব শ্রেণি বৈষম্যের এই ভগ্ন-চূর্ণ দশাকে উলঙ্গ করে দিয়েছে।

বর্তমান শিল্প ও প্রযুক্তি নির্ভর পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় মানুষকে আর মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। মানুষকে বিবেচনা করা হয় যন্ত্রের সাথে। শিল্প-কারখানায় একজন শ্রমিক একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতটি পণ্য উৎপাদন করল তা পরিমাপ করেও ন্যায্য মজুরি প্রদান করা হয় না, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই বললেই চলে।

অন্যদিকে, মুনাফা লুটে নেয় আঙুল দাগানো মালিক শ্রেণি। একইরকম সমাজের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে কায়িক শ্রমিক, কৃষক, মজুর তাদের ন্যায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত।

এদিকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির কৃষক, শ্রমিক, মজুরের উৎপাদিত পণ্যের ওপর ভর করেই উচ্চবিত্তের জীবন-জীবিকা আর অর্থ-সম্পদের পাহাড়। দুটি শ্রেণির মধ্যকার পার্থক্য এটিই যে, একদল শোষক আর অন্যদল শোষিত। সর্বপরি বলা যায় যে, এই আধুনিক বৈষম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা নতুন মোড়কে জমিদারি ও দাসপ্রথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর