নদীভাঙন কি মানববন্ধন বুঝে?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 16:12:04

 

হঠাৎ করে সারা দেশের নদীর পাড়গুলোতে প্রচন্ড ভাঙন শুরু হয়েছে। দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সব দিক থেকেই ছোট বড় অনেক নদীপাড়ের মানুষ ভাঙন আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। হিমালায়ের পাদদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় সিকিম, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতিতে বন্যা হবার পর ছোট-বড় সব নদী দিয়ে ধেয়ে আসে সেই পানি। উজানের নদী  কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর গঙ্গাধরের ভাঙনে মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। তারা গঙ্গাধর নদের ভাঙা তীরের মাটি ঘেঁষে মানববন্ধন করছেন। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই পরস্পরের হাত ধরাধরি করে নাগেশ্বরীর বল্লভের খাস ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গাধরের দিকে তাকিয়ে মিনতি করে যেন বলছে- ওরে গঙ্গাধর আর সামনে ভাঙিস না, মোর এতটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু নদীর তো আর মানুষের মিনতি শোনার মত কান নেই। সে তো আর মানব বন্ধন কি তা বোঝে না! তবুও মানুষ অসময়ে নদীর তীরে এসে ভিড় করে-সময় থাকতে নদীকে গুরুত্ব দেয় না।

উত্তরের তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, ব্রহ্মপুত্র, ছোট যমুনা, করতোয়া কাঁটাখালি সব নদীতেই এখন পানির নিম্নটান। বন্যা কমে গিয়ে পানিতে টান পড়লে নদীতে প্রচন্ড ভাঙন দেখা দেয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। কালমাটি, রাজপুর, উলিপুরে তিস্তা নদী, কাঁঠালবাড়ী, কুড়িগ্রামে ধরলা নদী, জোড়গাছ, চিলমারী, ইসলামপুরে ব্রহ্মপুত্র নদী, সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর, বাঘাবাড়িতে যমুনা নদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, নড়িয়ায় পদ্মা নদী যেন গত বছরের চেয়ে এবছর আরো বেশী প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে কূলে আঁছড়ে পড়ছে।

যমুনার ভাঙনে গোবিন্দাসীর ভালুকটিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বড় মসজিদ নদীর স্রোত থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। মসজিদ রক্ষায় গ্রামবাসীরা গাছ, কাঠ, বাঁশ নিয়ে নদীতে নেমে আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্রোতকে ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দেবার। কিন্তু স্রোতের তান্ডবে চেষ্টার পরিমান খুবই সামান্য মনে হচ্ছে। টিনের চালাঘর বড় নৌকায় তুলে নদী পাড়ি দিয়ে ডাঙ্গায় কোথাও গিয়ে বসতি গড়ে বাঁচার চেষ্টা করছে নদী ভাঙনাক্রান্ত হতাশ মানুষ।

রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের নিকট কাজীরপাড়া জামে মসজিদটি আরো তিনটি বাড়িসহ ৩০ মিটার এলাকা নিয়ে মাত্র ১ মিনিটে পদ্মার পেটে চলে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে নড়িয়ার বাজার, মাজার, স্কুল, অফিসঘরসহ অনেক তিন-চারতলা বিল্ডিং নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছিল ওটাই শেষ বিনাশ। আর পদ্মা এদিকে ভাঙ্গতে আসবে না। কারণ, নানা সরকারীভাবে ভাঙন বন্ধে আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়েছিল। সে অনুযায়ী কাজ হয়েছে যৎসামান্য। ফলে এবছর আরো বেশী ভাঙনের কবলে পড়েছেন এলাকাবাসী। এ বছর স্রোতের তীব্রতা বেশী হওয়ায় বাজার স্কুল, মসজিদ নিমিষেই নদীতে চলে যাচ্ছে।

নদীর দেশ বাংলাদেশ। প্রতিবছর প্লাবন ও তার সাথে নদীভাঙন আমাদের অমোঘ নিয়মের একটি। বন্যা শুরু হবার আগে একদফা নদী ভাঙে। বন্যার পানি কমে যাবার সাথে সাফে আরেক দফা নদী ভাঙন শুরু হয়। তবে বন্যা পরবর্তী নদী ভাঙনটাই বেশী মারাত্মক। এ সময় স্রোতের টান ভাটির দিকে বেশী হওয়ায় নদী তীরের নরম মাটি, বালু কোনভাবেই নিজেকে স্রোতের সাথে টিকিয়ে রাখতে পারে না। ফসলী জমি, বাড়ি-ঘর, বাজার-ঘট, মসজিদ-মন্দির, অফিস, পাঠাগার সবকিছুই স্রোতের তোড়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, অসহায় মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখে। সরকারী লোকজন আসে, মিডিয়ার ক্যামেরা আসে, ছবি তোলে দেশবাসীকে জানায়। তারা বরাদ্দ চায়, অর্থ পায় এবং কাজও করে। কিন্তু নদী নাছোড়বান্দার মত ফিবছর আবারো ভাঙে, আরো বেশী শক্তি নিয়ে। নদী কারো শাসন-বাঁধন মানে না। কর্তৃপক্ষের সেসব শাসন-বাঁধন নদীর কাছে দুর্বল মনে হয়-হয়তো বা তাই বলে সে আবারো প্রবল স্রোত সাথে নিয়ে গর্জে উঠে। মহাসড়ক, ব্রীজ, কালভার্ট, রেলসড়ক, বড় মসজিদ, ছয়তলা কলেজ সবকিছুই নদীর পেটে ঢুেক যায় অনায়াসে। আমরা গত কয়েক বছর ধরে এ কষ্টগুলো দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছি।

আক্রান্ত মানুষ বেশী উৎকণ্ঠ প্রকাশ করেলে সরকারী লোকজন এস বালুর বস্তা, কংক্রিটের চাকতি ফেলে ভাঙন ঠেকানোর নিষ্ফল চেষ্ট করে। ততদিনে স্রোত কমে গেলে যে যার মত সট্কে পড়ে অকুস্থল থেকে। আমরা শুনি, নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে। ওকূলে জমি জেগে উঠে, বসতি গড়ে উঠে। কিন্তু সেগুলো দখল করে নেয় সেই কূলের  লাঠিয়াল, জোতদার বাহিনী। যে এ কূলে জোত-জমি হারায় সে অপর কূলে গিয়ে কখনও সেই জোত-জমি ফিরে পায় বলে এমন ঘটনার নজির খুব কম শোনা যায়।

নদীভাঙন আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি। সেটার কথা আমরা জানি, দুশ্চিন্তা নিয়ে মনে মনে ভাবি। কিন্তু সঠিক সময়ে বা খরার মধ্যে এর প্রতিকার না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকি। একনেকে নদীভাঙন ঠেকাতে পরিকল্পনা পাশ হয়, যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ্ আসে কিন্তু সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করি না, শেষ করতেও পারি না। কাজ শেষ করার আগে নতুন করে বন্যা আঘাত হানতে শুরু করে। উপায়ন্তর না দেখে বালির বস্তা সম্বল করে হৈ-হুল্লোর শুরু করে দিই প্রতিবছর। বন্যা বা ভাঙন শুরু হবার পর সবার টনক নড়ে। বন্যার পানির স্রোতের মধ্যে অথবা ভাঙন কবলিত তীরের মধ্যে আনাড়ি লোক দিয়ে নদীর পানিতে বালুর বস্তা ছুঁড়ে দিই। এটাই কি নদী ভাঙন রোধের প্রকৃত উপায়? আমি শিশুকাল থেকে এমনটি দেখে আসছি। তখন নদীপাড়ে গিয়ে বালুর বস্তা ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্য মজা করে দেখতাম। এখন নানা টিভি চ্যানেলে আরো সুন্দর করে এসব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

প্রবল স্রোতে বালুর বস্তাগুলো কোথায় ভেসে যায় তার কোন দৃশ্য কোন ক্যামেরাতে ধরা পড়ে না। সেগুলো প্রতিবছর কোথায় যায় কে জানে? নদীতে ঘোলা পানি না হলে আন্ডার-ওয়াটার ক্যামেরা ফিট করলে তা হয়তো দেখা যেত, বোঝা যেত।

ভাবছেন, হয়তো আমি কৌতুক করছি। কিন্তু তা মোটেও নয়। নদভিাঙ্গা মানুষগুলো ‘পরিবেশ রিফুজি’। তাদের খাবার পানি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ, শুকনো খাদ্য থাকে না, বিপদের সময় তাদের শোবার জায়গা রাস্তা, মল-মূত্র ত্যাগের জায়গাও রাস্তা। গবাদি পশুগুলোর বড় দুর্গতি হয়, পশুখাদ্য পানির নিচে থাকায় তারা খাদ্যাভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। মানুষগুলো ডাইরিয়া, আমাশয়, জ্বর ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে অল্পদিনেই।

বন্যা বা নদী ভাঙনের সময় নদী তীরে যারা মানববন্ধন করছেন তারা আসলে কাকে কী মেসেজ দিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। আপনারা বর্ষা শুরুর আগে বা শীতকালে মানববন্ধন করুন। আর বলুন, এবছর বর্ষাকালে বৃষ্টি নামার আগেই যেন নদীতীরে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে বাধা হয়ে যায়। ভাঙন কবলিত এলাকায় জাভা বা ওকিনাওয়ার মত বড় তিনকাঁটাওয়ালা সিঙ্গাড়া টাইপের ব্লক ফেলা হয়-যেটা স্রেতে ভেসে নিতে পরবে না। নদীতীর বাধন, নদীশাসন, এসব যাদের কাজ তাদের একাগ্রতা, জবাবদিহিতা ও টেকসই নির্মানের নিশ্চয়তা, নৈতিকতা ইত্যাদির নিশ্চয়তা চাই জানিয়ে দাবি তুলে ধরতে হবে। নতুবা জনগন এই হেঁয়ালী কাজকে কোনভাবে গ্রহণ করবে না, মেনে নেবে না। কারণ, মানববন্ধন করে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষকে বা কর্তৃপক্ষকে দেখাতে হবে। সঠিক দাবি উপযুক্ত লোকের কাছে পৌঁছাতে হবে। নদীভাঙনের সময় নদীরা বেহুঁশ থাকে। সেসময় কোন নদীর নিজের এসব মানববন্ধন দেখা বা শোনার মত কোন সামর্থ্য, সক্ষমতা কোনটাই  নেই।  প্রতিবছর বন্যা ও নদীভাঙন শুরু হবার পর শুধু অসময়ে অরণ্যে রোদন করে কোন ভাল ফল আশা করা বৃথা।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর