বিশ্বাসে নির্বাচন, তর্কে বর্জন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. হারুন রশীদ | 2023-08-31 11:35:06

নির্বাচন আমাদের দেশে উৎসব। গণতন্ত্রের এই উৎসবে একদিনের জন্য হলেও ভোটাররা মনে করেন তারাই দেশের মালিক। কারণ, তাদের রায়েই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। যাকে পছন্দ হবে ভোট দেবেন, পছন্দ না হলে ভোট দেবেন না। এই ক্ষমতাটুকু একজন ভোটার দারুণভাবে উপভোগ করেন। এটা তার অধিকার। একজন ভোটারকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই।

নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় নানা শ্লোগান জনপ্রিয় হয়েছে। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। দেখা গেল এই শ্লোগানে একটু সমস্যা আছে। কারণ যাকে-তাকে ভোট দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই পরবর্তী সময়ে এই শ্লোগান হয়ে গেল আমার ভোট আমি দেব, দেখে শুনে বুঝে দেব।

আবার ভোটের সাথে ভাতেরও একটা সম্পর্ক নির্ণয় করলেন রাজনীতিকরা। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করার কথাও গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হতে থাকলো। এখন দারিদ্র্য কমেছে। তাই আপাতত ভাতের অধিকারের ব্যাপারটি খুব বেশি আলোচনায় আসছে না। তবে ভোটের অধিকারের বিষয়টি সমধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচন এলে ভোটের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। কারণ এই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব। তাই যারা ক্ষমতাসীন তারা আবার নির্বাচিত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ক্ষমতার বাইরে থাকেন যারা তাদেরও লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। দুই পক্ষই জিততে চান। কেউ হারতে চান না। আর সমস্যার শুরু এখানেই।

সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন যেন সোনার পাথরবাটি। সরকারি দল, বিরোধী দল কেউ কারো ওপর আস্থা রাখতে পারে না। এজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল। ততত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোও বিতর্কমুক্ত থাকেনি। কখনো সূক্ষ, কখনো বা স্থূল কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে। তাছাড়া ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটির কবর রচনা করেন। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপ হয়েছে। এখন সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান।

এজন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিকল্প। সবাই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে এক রকম। ক্ষমতার বাইরে গেলে আরেক রকম।

আমাদের দেশে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নেওয়ার সংকট। সবাই তাল গাছটা নিজের করে চায়। এতে করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার একটি চেষ্টা থাকে সকল পক্ষ থেকেই। এছাড়া নির্বাচনী সংঘাত, সংঘর্ষ, প্রভাব বিস্তার এগুলো যেন নির্বাচনী সংস্কৃতির অংশই হয়ে গেছে। একদিকে নির্বাচন কমিশনের ওপর দায় চাপানো হয়, অন্যদিকে যার যেখানে প্রভাব আছে সেটি তারা দেখাতে কার্পণ্য করেন না। শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি সুষ্ঠূ নির্বাচন উপহার দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ যদি সংশ্লিষ্ট সকলে কমিশনকে সহযোগিতা না করেন।

নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চললে কোনো সংকটই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এমনটি বলা যাবে না। তবে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে নির্বাচন কমিশনকেই জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। দেশে অনেকগুলো নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। তাদেরও কার্যকলাপও দেখেছে দেশবাসী। এই সময় দৃঢ় মনোবলের স্বাধীনচেতা কমিশনও যেমন ছিল তেমনি ছিল চরম আজ্ঞাবহ কমিশনও। এবার সময় এসেছে সত্যিকারের শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশনের। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের দিকে চেয়ে আছে দেশবাসী।

নির্বাচন কমিশন বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। তাই শুধু মুখে মুখে স্বাধীন কমিশনের কথা না বলে নির্বাচন কমিশন যেন সত্যিকার অর্থে স্বাধীন কমিশন হয়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। স্টেকহোল্ডার বা রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

নির্বাচন কমিশনেরও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে কাজ করতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য অনেকগুলো নিয়ামক কাজ করে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বচ্ছ, নির্ভুল ভোটার তালিকা। এছাড়া নিরপেক্ষ প্রশাসন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, ভোটার এবং সমর্থক-সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একান্ত অপরিহার্য।

আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থায় বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে যেগুলো আশাব্যঞ্জক। গুন্ডা, হোন্ডা-নির্বাচন ঠাণ্ডার দিন শেষ। এখন দলবেঁধে সমর্থক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যায় না। রঙিন পোস্টার করাও নিষিদ্ধ। সেই পোস্টার আবার দেয়ালেও লাগানো যাবে না। নির্দিষ্ট মাপের হতে হবে পোস্টার। প্রচারের সময়সীমারও রয়েছে বাধ্যবাধকতা। কারা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন সে বিষয়েও রয়েছে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা। দেখা যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা বেশ ভালভাবেই নিয়মগুলো মেনে চলছেন। নির্বাচন ব্যবস্থায় এই উত্তরণও কম অর্জন নয়।

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোও তৎপর হয়ে উঠছে। জোট, পাল্টা জোট গঠন হচ্ছে। এটাও নির্বাচনেরই অংশ। এইসব তৎপরতাকে নির্বাচমুখী হওয়ার আভাস হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। সময়মত নির্বাচন হোক- এটি দেশের মানুষের একান্ত চাওয়া। নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হোক-এটিও চাচ্ছে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাই বর্জন-বয়কটে কোনো অর্জন নেই বলেই মনে করছেন সাধারণ মানুষ।

দলীয় সরকার হোক আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক- কারো না কারো ওপর তো বিশ্বাস রাখতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের কথায়- মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় জনগণের (মানুষের) দোহাই দিয়ে সবকিছু করে। সেই মানুষে বিশ্বাস করে কুতর্ক ও যুক্তিহীনতার পথ পরিহার করে বিশ্বাসের পথে হাঁটতে হবে। কারণ বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর