প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-09-01 23:27:13

সংসদ নির্বাচন আসন্ন। যেকোনো সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এরপরই তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, নভেম্বরের প্রথম দিকেই হয়তো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।

কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার আগেই নির্বাচনী আসনগুলোতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়ে গেছে। থানা ও জেলাগুলো এখন প্রার্থীদের পরোক্ষ প্রচারণায় মুখর। ভোটার তথা জনগণও সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা-বিশ্লেষণ করছেন। কোন প্রার্থী কী রকম, বা কে কোন দলের মনোনয়ন পেতে পারেন তা নিয়ে জনগণের মাঝে আলোচনা হচ্ছে। এক কথায়, প্রাক নির্বাচনী কর্মযজ্ঞে মুখর এখন পুরো দেশ।

দেশে নির্বাচন সম্পর্কিত আইন আছে। আইনে প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি ও প্রচার-প্রচারণার বিধিনিষেধ রয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এরকম প্রচারণা আইনসিদ্ধ কিনা সে বিষয়ে প্রার্থীদের সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনের আচরণবিধি সম্পর্কে অনেক প্রার্থীই সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। এতে করে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হয়। অনেকের প্রার্থীতা বাতিলও হয়ে যেতে পারে।

সংবিধানের ৬৬ (১) অনুচ্ছেদে আছে- বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের বয়স যদি ২৫ বছর পূর্ণ হয় তবে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হতে চাইলে প্রথমত তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত তার বয়স হতে হবে ২৫। সংবিধান অনুযায়ী এ দু’টি হচ্ছে সংসদ সদস্য হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু একই অনুচ্ছেদে এই দু’টি শর্তের পাশাপাশি আরো কিছু শর্ত রয়েছে যেগুলো উত্তীর্ণ হলেই একজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। এগুলো হলো- কোনো আদালত যদি একজন প্রার্থীকে অপ্রকৃতস্থ হিসেবে ঘোষণা করেন, যদি তিনি দেউলিয়া ঘোঘিত হওয়ার পর অব্যাহতি লাভ না করেন, যদি তিনি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর না হয়ে থাকে। এছাড়া ৬৬ অনুচ্ছেদে আরো কয়েকটি বিষয় রয়েছে যেগুলো একজন প্রার্থীর অবশ্যই জানা জরুরি। উপরোক্ত কারণগুলোর যেকোনো একটি বিদ্যমান থাকলেই একজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়ে যেতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে একজন প্রার্থীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। সেই সাথে আইনে রয়েছে, ওই প্রার্থীকে বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হবে। প্রার্থী যে এলাকার ভোটার বা বাসিন্দা তাকে সে এলাকারই প্রার্থী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু প্রার্থীর মনোনয়নপত্রে একজন স্থানীয় ভোটারকে প্রস্তাব করতে হয়। এই প্রস্তাবকারীকে প্রার্থী যে এলাকায় নির্বাচন করবেন সে এলাকার ভোটার হতে হয়। একইভাবে ওই প্রস্তাব সমর্থনকারীকেও ওই নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হয়। বাইরে থেকে অন্য কেউ এসে প্রস্তাবক ও সমর্থক হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

একজন প্রার্থী তার মনোনয়নপত্রটি তিনি নিজে বা তার প্রস্তাবকারী বা প্রস্তাব সমর্থকারী রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করবেন। রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার তারিখ ও সময় উল্লেখ করে ওই মনোনয়নপত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করবেন।

বিদ্যমান আইনানুযায়ী মনোনয়নপত্রের সাথে প্রার্থীকে একটি হলফনামাও জমা দিতে হয়। এই হলফনামায় একজন প্রার্থীকে আট ধরনের তথ্য জমা দিতে হয়। হলফনামায় থাকে- প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফৌজদারি মামলায় সংশ্লিষ্টতার/অভিযুক্ততার বিবরণ, পেশা ও আয়ের উৎস, সম্পদের বিবরণ ইত্যাদি।

আমরা জানি, নির্বাচন হওয়ার আগে প্রার্থীরা ভোটাদের কাছে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। এটি একটি বৈশ্বিক রীতিও বটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচিত হওয়ার পর আগের সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। সে জন্য মনোনয়পত্রে একজন প্রার্থী আগে কখনো নির্বাচিত হয়ে তার আগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের অগ্রগতিরও একটি ফিরিস্তি দিতে হয়।

নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা আমরা শুনি। কিন্তু জামানত হিসেবে কত টাকা জমা দিতে হয় তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী একজন প্রার্থীকে মনোনয়নপত্রের সাথে ২০ হাজার টাকা জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়।

নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসভায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা নেতা-নেত্রীদের সামনে লোকবল নিয়ে শো-ডাউন করে থাকেন। দলের টিকেট পাওয়ার জন্যই এ শো-ডাউন। আইনে এ বিষয়ে বাধানিষেধ না থাকলেও মনোনয়পত্র জমা দেয়ার সময় লোকজন নিয়ে মিছিল করে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে। এছাড়া তফসিল ঘোষণার আগে সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে যেকোনো ধরনের প্রচারণা আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও আমরা অহরহই এরকম প্রচারণা দেখি।

একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মনোনয়পত্র জমা দেয়ার সময় তার নির্বাচনী এলাকার ১% ভোটারের সমর্থন একটি তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। তবে আগে তিনি সংসদ সদস্য হলে এই সমর্থনসূচক তালিকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ বিধানটি রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট কোনো প্রাথীর ক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই। এ বিধানটির সংশোধন নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে।

নির্বাচন কমিশন যে কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করার এখতিয়ার রাখে। তবে, বাতিল করার অবশ্যই কোনো না কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ থাকতে হবে। মনোনয়নপত্রে কোনো অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য থাকলে কমিশন মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারে। ফলে, হলফনামায় প্রদেয় তথ্য সম্পর্কে প্রার্থীদের বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। কারণ, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে তা বিদ্যমান ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৮১ ধারায়ও দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে, সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধনযোগ্য ছোট-খাটো ভুলের জন্য কমিশন মনোনয়ন বাতিল করেন না।

সংবিধান ও বিদ্যমান আইনে ঋণ ও বিল খেলাপিরা নির্বাচনের অযোগ্য। এছাড়া বিদেশি সাহায্য সংস্থার নির্বাহী, পদত্যাগ বা অবসরের তিন বছরের মধ্যে প্রার্থী হতে পারবেন না। এছাড়া সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।

কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তিনি মুক্তিলাভের পর যদি পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয় তবে তিনি প্রার্থী হতে পারবে না। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের অন্যতম কারণ এই বিধান। তবে, চুড়ান্তভাবে দণ্ডিত হতে হবে না কি বিচারিক আদালতের দণ্ডই যথেষ্ট-এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের দুই ধরনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। শেষ কথা হচ্ছে, প্রাথীদের সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো অনুসরণ করেই মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিত। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটি অপরিহার্য।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: আইনজীবী, কলামিস্ট ও কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর