ডিজিটাল সামাজিক সম্পর্ক ও ‘তরল সমাজ’ এর পুনঃপাঠ

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-09-01 10:57:20

ডিজিটাল সামাজিক সম্পর্ক ডিজিটাল সমাজবিজ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি এখন বিশ্বজুড়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের জীবনের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠেছে। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে পার্সোনাল কম্পিউটার এবং ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে ইন্টারনেটের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুর পর থেকে বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে।

এগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছেছে, যা পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অবসর ক্রিয়াকলাপ, বেতনভুক্ত কাজ, শিক্ষা, বাণিজ্য এবং গণমাধ্যমকে উপস্থাপন এবং উপভোগ করার উপায়গুলোকে প্রভাবিত করেছে। মানুষের আচরণ, ব্যবহার এবং সর্বোপরি আন্ত:ব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিগুলো ভিন্ন মাত্রার সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করছে যা প্রথাগত সামাজিক সম্পর্ক থেকে ভিন্ন। এটাকে এখন অনেকেই ডিজিটাল সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করছেন।

নতুন ডিজিটাল মিডিয়া প্রযুক্তি সমাজের অনেক মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং সামাজিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। সারা বিশ্বে মানুষ ডিজিটাল মিডিয়া এবং নেটওর্য়াক দ্বারা অভ‚তপূর্ব উপায়ে একত্রিত হচ্ছে। ফলস্বরূপ, তাদের মধ্যে একটি ডিজিটাল সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে যা সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার অন্যতম একটি ক্ষেত্র হয়ে ওঠেছে।

‘লিকুইড সোসাইটি’ তত্ত¡টি বিশিষ্ট পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক জাইগমুন্ট বাউমান ২০০০ সালে প্রকাশিত তার ‘লিকুইড মর্ডানিটি’ শিরোনামের বইতে উপস্থাপন করেন। ‘তরল’ বলতে এখানে সেসব পদার্থ বুঝায়, যেগুলো আমাদের সমাজে প্রবাহিত হয়, ছিটকে যায়, ফোঁটা হয়- যার অর্থ সম্পর্কের দিক দিয়ে আমরা ‘কঠিন’ থেকে ‘তরল’ পর্যায়ে রূপান্তরিত হচ্ছি। ‘তরলতা’ আগের ‘স্থিতিশীল’ ও ’দৃঢ়’ সর্ম্পকের ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানে, সমাজ বলতে বোঝায় একদল মানুষ যারা একটি নির্দিষ্ট স¤প্রদায়ের মধ্যে বাস করে এবং একই সংস্কৃতির অংশীদার। বৃহত্তর পরিসরে, সমাজ আমাদের চারপাশের মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান, আমাদের বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ধারণা নিয়ে গঠিত। সাধারণত, আরও উন্নত সমাজগুলো একটি রাজনৈতিক কর্তৃত্বও ভাগ করে নেয়।

বাউমান বর্তমান সমাজকে একটি ‘তরল’ পদার্থের সাথে তুলনা করেছেন যেখানে প্রতিটি মানুষ একটি তরলের কণার মত আচরণ করে, যার অর্থ হলো তাদের মধ্যে বন্ধনগুলি আগের সমাজের মতো শক্তিশালী নয় এবং বিভিন্ন ধরনের শক্তি প্রয়োগ করেও সমাজ তার নিজস্বতা ধরে রাখতে পারে না। তিনি মনে করেন, আধুনিকতার নামে সমাজ ও রাষ্ট্রের চেহারা পরিবর্তনের সময় থেকেই সমাজের তরলীকরণের এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এবং তার মতে, এই ধরনের সমাজে নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মতো বিষয়গুলো প্রধান ভূমিকা পালন করে।

বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নয়ন হয়েছে এবং একই সাথে সমাজের মৌলিক কাঠামোতে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে। যাইহোক, এই পরিবর্তনগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল যে সমাজের মানুষের মধ্যে সংযোগের গভীরতায় দূরত্ব তৈরি করছে এবং সামাজিক বন্ধনের দৃঢ় এবং শক্তিশালী বন্ধন ক্রমশ সংকীর্ণ এবং দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।

এই ডিজিটাল যুগে আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ তথ্য, অর্থ বা পণ্য পাঠাতে পারি- মানুষের সাথে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ ছাড়াই। আমরা মানুষের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও তৈরি করছি এবং বলা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে অনেক ধররের কাজ করানো যাবে। নতুন প্রযুক্তির এই যুগে, আগের শিল্পসমাজ একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইনফরমেশন সোসাইটি’ বা ‘তথ্যভিত্তিক সমাজ’।

আমাদের এখন আছে অত্যাধুনিক কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট। এই নতুন তথ্যভিত্তিক সমাজে, আমরা দেখি যে ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থার অকল্পনীয় উন্নতির ফলে মানুষের মধ্যে দূরত্ব সংকুচিত হয়েছে। এখন, আমরা ভিডিও কলের মাধ্যমে আমাদের থেকে দূরে কারও সাথে কথা বলতে পারি। আমরা মিটিং বা অন্যান্য কাজে গুগুলমিট, স্কাইপ ও ওয়েবক্যাম ব্যবহার করছি।

ফেসবুক, ট্যুইটার, লিঙ্কডইন, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল জগতে বিভিন্ন মহাদেশের মানুষের সাথে যুক্ত হচ্ছি বা বন্ধুত্ব করছি যা বাস্তব জগতে হয়তো সম্ভব ছিল না। গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে আমরা পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে খবর পাচ্ছি। প্রযুক্তির এই দ্রæত বিকাশের কারণে বিশ্বায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং এর সুফল সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তির এই সর্বব্যাপী উন্নয়নের ফলে সমাজের মৌলিক কাঠামোতে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে?

বাউমানের তত্ত¡ অনুসারে, তরল সমাজে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে, একদিকে মানুষের ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলো অনেকভাবে প্রসারিত হতে পারে, কিন্তু অন্যদিকে, আশেপাশের মানুষের সাথে দৈনন্দিন সর্ম্পকের বন্ধনগুলো সংকীর্ণ হচ্ছে এবং দুর্বল মানুষ ক্রমাগত কাছের মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সম্পর্কে টানাপোড়েন হচ্ছে এবং দিন শেষে সবাই চরম একাকীত্বের শিকার হচ্ছে। একই সময়ে, পুঁজিবাদী উন্নয়ন দর্শনের সর্বব্যাপী বিস্তারের ফলস্বরূপ, মানুষ তাদের নিজেদের ভালোর জন্য অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

বাউমানের মতে, মানুষ শিল্প সমাজের ‘শক্ত’ হার্ডওয়্যারভিত্তিক আধুনিকতা থেকে ‘তরল’ সফ্টওয়্যার ভিত্তিক আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্যভিত্তিক সমাজ এখন একটি ‘তরল সমাজ’ তৈরি করছে। এই তরল সমাজের বৈশিষ্ট্য হল এটি বৈশ্বিক ব্যবস্থার অনিয়ন্ত্রিত ও দূরবর্তী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, অসংগঠিত এবং শিথিলভাবে আবদ্ধ সামাজিক সম্পর্ক যা মানুষকে অনিশ্চিত ও অনিরাপদ জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

এই অনিশ্চয়তার কারণে, একের পর এক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তাই মানুষ সবসময় যে কোন অপ্রত্যাশিত সমস্যা নিয়ে চিন্তিত থাকে। একটি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আরেকটির উদয় হচ্ছে। কারণ এই নতুন সমাজে আরো অনেক বিষয় আছে যা প্রতিনিয়ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে এবং কি হবে তা কেউ আগে থেকেই জানে না। এটি সমাজে ঝুঁকি বাড়াই, যাকে উলরিচ বেক ‘রিস্ক সোসাইটি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই ঝুঁকিপূর্ণ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যেমন পরিবেশ দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রোগ, ব্যাধি, মহামারি ইত্যাদি এই ধরনের সমাজে মানুষকে একাই মোকাবিলা করতে হয়।

কোভিড-১৯ এই ঝুঁকির একটি ভালো উদাহরণ। এটা প্রমাণ করেছে যে, এই সমাজে জীবন কতটা অনিরাপদ এবং অনিশ্চিত। অতএব, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারগুলোকে এমন কর্মসূচিতে মনোনিবেশ করতে হবে যা তার নাগরিকদের অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার সমাধান করে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নয়নের এমন দর্শন তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক শক্তিশালী হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি হবে। এভাবেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্ত সামাজিক সম্পর্কভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর