ইলিশ মাছ কবে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে?

, যুক্তিতর্ক

মোশারফ হোসেন | 2023-08-31 23:41:17

ইলিশ! নামেই যেন স্বাদের এক অন্যরকম মোহনীয়  আবেশ মিশে আছে। তাই নাম শুনতেই কেমন জানি নাসারন্ধ্র সচল হয়ে যায়-- জিহবায় কিছু না লাগলেও জলের আনাগোনা ঠিকই টের পাওয়া যায়। এই ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। তবে এ মাছ দেশের  কত শতাংশ মানুষ খেতে পারে- সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। আমি পেশায় একজন ব্যাংকার, একটি ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক। নিজের সমসাময়িক ব্যাংকারদের মতো মোটা বেতন না পেলেও সম্মানজনক বেতন পাই নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমিও গত কয়েক বছরে একবারই ইলিশ মাছ কেনার কথা মনে করতে পারছি!

ইলিশে আমার অরুচি, ব্যপারটা কিন্তু এমন নয়। আকাশছোঁয়া দামের কারণে আমি ইলিশ কেনার জন্য নিজেকে সামর্থ্যবান মনে করতে পারিনি এবং কখনো কখনো দাম জিজ্ঞেস করে লজ্জায় পড়ার ভয়েও পিছিয়ে এসেছি। অথচ অতি ঈপ্সিত এই ইলিশ সবার জন্য সহজলভ্য না করে বিগত কয়েক বছর বাদে প্রতি বছরই আহরিত ইলিশের সিংহভাগ রফতানি করা হতো। যদিও সরকারি সিদ্ধান্তে কয়েক বছর ইলিশ রফতানি বন্ধ রয়েছে, তবুও একটা বিশেষ শ্রেণির পয়সাওয়ালা মানুষ ছাড়া এখনো দেশের সাধারণ মানুষ ইলিশ খেতে পারে না। তাছাড়া রফতানি বন্ধ নাকি বন্ধ নয়- এ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। পত্রপত্রিকায় কেস-টু-কেস ভিত্তিতে ইলিশ রফতানি অনুমোদনের খবর পাই আমরা। তাছাড়া অবৈধভাবে এবং চোরাপথে স্বাভাবিকভাবে রফতানি হওয়া ইলিশের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণে ইলিশ পাচার হচ্ছে সরাসরি সাগর থেকেই; ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের চাঁদপুরের ইলিশ পাওয়া যায়- এমন খবরও মিডিয়াতে এসেছে। তাই দেশিয় বাজারে ইলিশ কখনোই পর্যাপ্ত হয়নি, দামেও সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি।                       

সম্প্রতি করোনার ছোবলে  শারীরিক, মানসিক  এবং আর্থিকভাবে খুব বিপর্যস্ত সময় পার করছি। পরিবারের সবাই করোনায় আক্রান্ত হওয়াতে ব্যক্তিগত অর্থনীতি উলটপালট হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক যে অভিজ্ঞতাটি নতুন হয়েছে, সেটি হচ্ছে- মুখের রুচি এবং নাকের গন্ধ একেবারে চলে যাওয়া। আমার পরিবারে প্রথম আমি করোনায় আক্রান্ত হই। আমি সুস্থ হওয়ার দশ দিন পর একে একে আমার বয়স্ক ও নিয়মিত ওষুধ সেবন-করা মা-সহ পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয়েছে। তবে ভয় আর দুশ্চিন্তা করতে হয়েছে আম্মাকে নিয়েই, কারণ আম্মা কিছুই খেতে পারতেন না। একইসাথে টানা দশ দিন আম্মার বমি হয়েছে। তাই আম্মার শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে আম্মাকে কিছু খাওয়াতে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, 'আম্মা তুমি কী খাবে, কী খেতে ইচ্ছে করে?' আম্মার একটাই উত্তর, 'না বাবা, কিচ্ছু খাবো না!' তাই নিজে থেকেই চিন্তা করে আম্মার জন্য এটা-ওটা কিনে এনেছি। কিন্তু আম্মা এক কামড়, দুই কামড়ের বেশি কিছুই খেতেন না।

এরই মধ্যে একদিন সকালে মাছ ও কাঁচা তরকারি কিনতে বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে দেখি, প্রায় সোয়া কেজি সাইজের ইলিশ উঠেছে। 'ভাই, ইলিশ কত করে কেজি?', জিজ্ঞেস করতেই মাছ বিক্রেতা পান চিবাতে চিবাতে কঠিন চেহারায় ভারী কন্ঠে জবাব দিলেন, 'এক দাম তের শ' টাকা কেজি!' এত টাকা নিয়ে বাজারেই তো আসিনি! মাথা নিচু করে দুই কেজি দেশি পাঁচমিশালি মাছ কিনে বাসায় চলে আসতে হলো। আসতে আসতে চিন্তা করলাম, 'কালকে না হয় ইলিশ কেনা যাবে।' কিন্তু বাসায় আসার আগেই পকেট, ব্যাংক একাউন্ট আর ক্রেডিট কার্ড ব্যালেন্সের যে হিসাবটা পেলাম, তাতে বুঝতে পারলাম- ইলিশ খেতে হলে ডাক্তার দেখানো ও চিকিৎসার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হবে! ১০ দিনে ১৫ বার ডাক্তার দেখাতে হয়েছে। মনে ভয়- সবাই সুস্থ হতে হতে না জানি আরও কতবার ডাক্তার দেখাতে হয়। তার উপর আবার নানা রকম টেস্ট এবং সাথে ওষুধ খরচ তো আছেই। আরও আছে ইমার্জেন্সিতে এ্যাম্বুলেন্স ও হাসপাতালে ভর্তির খরচ ম্যানেজ করার টেনশন! তাই ইলিশ আর কেনা হলো না। মনকে বুঝালাম, সেপ্টেম্বরে বেতন হলে আম্মাকে ইলিশ কিনে খাওয়াবো। তাই ইলিশের ভরা মৌসুম আগস্টে আর ইলিশ কেনা হলো না। জানি না, সেপ্টেম্বরের বেতনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে আসতে আমার মায়ের জন্য বাজারে ইলিশ আর থাকবে কিনা!

আক্ষেপের সাথেই বলতে হচ্ছে, ইলিশ মাছ কবে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে? যে ইলিশ দেশের গুটিকয়েক পয়সাওয়ালা ব্যক্তি আর ভিনদেশিরা ছাড়া আমরা সাধারণ বাংলাদেশিরা খেতে পাইনা, সে মাছ আমাদের জাতীয় মাছের খেতাব নিয়ে বসে আছে! খেতে পাই না, কিনতে গেলে দাম শুনে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে হয়, সেই ইলিশ দেশের বাইরে রফতানিও হবে কেন? নিজেকে অভুক্ত রেখে বিশ্ববাসীর উদরপূর্তির কোনো যুক্তি থাকতে পারে? দুটি যুক্তি থাকতে পারে, প্রথমটি হচ্ছে- দেশে ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ উদ্বৃত্ত, আর দ্বিতীয় কারণটি হতে পারে- দেশে ইলিশের বাজার নেই। কিন্তু ইলিশের ক্ষেত্রে দুটো কারণের কোনটাই সত্যি নয়। হতে পারে ইলিশের আন্তর্জাতিক বাজার দেশের বাজারের তুলনায় ভাল, তবে ইলিশের বাজার সবার সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসলে দেশেও ইলিশের বাজার অনেক সম্ভাবনাময় হবে নিশ্চয়। রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন আমরাও সমর্থন করি, তবে জাতীয় মাছের স্বাদ জাতিকে পাইয়ে তারপর যদি উদ্বৃত্ত থাকে তাহলেই যেন ইলিশ রফতানি করা হয়। তাই বর্তমানে ইলিশ রফতানি বন্ধ আছে, বন্ধই থাকুক, পুরোপুরি বন্ধ থাকুক।

ইলিশের কথা না-হয় বাদই দিলাম। বাঁচার জন্য ইলিশ না হলেও চলবে। তবে নাগরিক জীবনে স্বস্তি দেওয়ার মত এমন প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই অপ্রতুল কিংবা অনুপস্থিত আমাদের জীবনে। নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই দিনে দিনে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তেল, চিনিসহ অনেক নিত্যপণ্যের দামই লাগামহীন হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে এসব পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এই বেঁধে দেয়া দামেও কিনতে পাওয়া যায় না এসব পণ্য। কী আর করার, সৎ জীবনযাপনের স্বার্থে ভোগ কমিয়ে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এসব প্রতিকূলতার সাথে।

কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত বাজার আর অধরা দামের কারণে ভোগের সাথে এই কম্প্রোমাইজের ফলেও দাম পড়ছে না। কোলকাতায় ইলিশ মাছ কয়েকজন মিলে শেয়ারে কেনার খবর দেখেছি পত্রিকায়। প্রথমে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হলেও নিজের অবস্থা বিবেচনা করে এটিকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। বাংলাদেশে শেয়ারে ইলিশ কেনার কোনো খবর যদিও এখনো পাইনি, তবুও হলফ করে বলতে পারি, এমন ব্যবস্থা এখনো চালু না হলেও, অচিরেই হয়ত হবে। তখন আর যা-ই হোক, নিম্ন আয়ের মানুষ জাতীয় ও বাঙালির ঐতিহ্যের বাহক ইলিশের স্বাদটা নিতে পারতো। আর এমনটা যদি না হয়, তাহলে  প্রতি মাসের আয়ের একটা অংশ সঞ্চয় করতে হবে পরের বছর ইলিশের মৌসুমে ইলিশ কেনার জন্য! জাতীয় মাছের স্বাদ নিতে সত্যিই যদি এমনটা করতে হয়, তাহলে নিশ্চয় এটা আমাদের জাতীয় অস্বস্তির কারণ হবে। তাই বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তোরণ না হলে, ইলিশের জাতীয় মাছের খেতাব থাকবে কিনা- সেটা ভেবে দেখতে হবে।  

আর জাতীয় মাছের খেতাব যদি বহালই থাকে, তাহলে ইলিশ যেন হয় সবার সাধ ও সাধ্যের নাগালে।  সবার জন্য ইলিশকে সহজলভ্য করতে ইলিশের প্রজনন, উৎপাদন, আহরণ ও বিপণনে সরকারি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত তদারকি ও জবাবদিহির মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। মা ইলিশ ও জাটকা নিধন রোধ এবং ইলিশের চোরাচালান বন্ধে কোস্টগার্ডসহ দায়িত্বশীল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ জাতীয়তাবাদের নিদর্শন রাখতে হবে। ইলিশ আহরণের সাথে যুক্ত জেলেদেরকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আনতে হবে এবং তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা বা ভর্তুকির  ব্যবস্থা রেখে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরাসরি জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ সংগ্রহ করে সরকারি নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম বিলুপ্ত করে ওএমএস পদ্ধতিতে সুষম বাজারজাতকরণের মাধ্যমে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে ইলিশ পৌঁছে দিতে হবে। এতে করে ইলিশের বাজার বাড়বে, দাম কমবে এবং নিম্নআয়ের মানুষের ইলিশের চাহিদাও মিটবে।

লেখক: মোশারফ হোসেন, ব্যাংকার কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর