দাপট, ক্ষমতা, ব্যারিস্টার মইনুল ও থামতে জানা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-09-01 04:40:33

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। একজন আইনজীবী এবং দৈনিক সংবাদপত্র দি নিউ নেশন-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও প্রকাশক। কয়েক বছর আগে তিনি ছিলেন দেশের বৃহৎ এবং জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান। তার আরেকটি বড় পরিচয় আছে। সেটা হলো তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ এর সাবেক উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। তার প্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ছিল তথ্য, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং ভূমি মন্ত্রণালয়। সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুখপাত্র হিসেবে তিনি প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যমে বিভিন্ন বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তব্যের মধ্যে প্রকাশিত হতো ক্ষমতা, দাপট আর অহমিকা!

সেই সময় তিনি বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘মির্জা আব্বাস কিসের রাজনীতিবিদ? সে তো একজন বাস ড্রাইভার। একজন বাস ড্রাইভারও যদি বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ হয়, তাহলে সেই রাজনীতির কি অবস্থা হয় আপনারাই বোঝেন।’

এছাড়াও তখন মইনুল হোসেন বিএনপির বর্তমান সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘রুহুল কবির রিজভী কে? এরাতো হলো পলিটিক্যাল ক্লাউন। এদের বিষয়ে আমি আর কি বলবো।’

অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, উপহাস করা, নিজের কায়েমী স্বার্থে কেউ ব্যাঘাত ঘটালে প্রয়োজনে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া-এমন এন্তার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, ১৯৭৪ সালে বাসন্তি নামে একজন পাগল নারীকে জাল পরিয়ে ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। এই ছবির মধ্যে দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হয়। পঁচাত্তরের ঘাতকদের প্রোপাগান্ডা হিসেবে এই ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এই বাসন্তিকে জাল পরানোর পরিকল্পনাটি মইনুল হোসেনের বলে অভিযোগ রয়েছে।

বরাবরই তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। ১৯৬৯ সালে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পরে সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ নামে কলাম লিখতে শুরু করেন। এই কলামে পাকিস্তানী দুঃশাসনকে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করতে থাকেন। কলামটি সে সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই সময়ে সিরাজুদ্দিন হোসেন দু-সপ্তাহের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি মাগুরা যান। একই সময়ে ইত্তেফাকে চাকরি করতেন জামায়াতের খোন্দকার আব্দুল হামিদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী। সম্পর্কে মইনুল হোসেনের আত্মীয়। সিরাজুদ্দিন হোসেনের অনুপস্থিতিতে "মঞ্চে নেপথ্যে” কলামটি মইনুল হোসেনের মারফতে খোন্দকার আব্দুল হামিদ ছিনতাই করে নেন। তিনি সেই থেকে সেখানে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন। এই লেখার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন।

সিরাজুদ্দিন হোসেন মাগুরা থেকে ফিরে এই অবস্থা দেখে রাগ করে ইত্তেফাক অফিসে যাওয়া ছেড়ে দেন। তখন মানিক মিয়ার স্ত্রী তাকে অনুরোধ করে আবার অফিসে নিয়ে আসেন। তবে তিনি “মঞ্চে নেপথ্যে” কলামটি আর ফেরত পাননি। মইনুলের ইচ্ছেয় পাকিস্তানের দালাল খোন্দকার আব্দুল হামিদকে দিয়েই কলাম চালু রাখা হয়। হামিদ সেখানে পাকিস্তানী মতাদর্শই প্রকাশ অব্যাহত রাখেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়ে দেয় পাক বাহিনী। পাকিস্তানী দালাল খোন্দকার আব্দুল হামিদের মাধ্যমে মইনুল হোসেন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তখন ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে এই টাকা নিয়ে মইনুল হোসেন বিদেশে চলে যান।

সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার সঙ্গেও তার যোগসাজশ ছিল বলে শোনা যায়। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতীয় চার নেতা হত্যার পর খুনি মোশতাককে নিয়ে ডেমোক্রেটিক লীগ করেছিলেন।

বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী ব্যারিস্টার মইনুল সম্প্রতি তৎপর হয়েছিলেন সরকারবিরোধী জোট গঠনের কাজে। কিন্তু একটি বেফাঁস মন্তব্যের কারণে তিনি বড় রকমের ধরা খেয়েছেন।

গত ১৬ অক্টোবর রাতে ৭১ টেলিভিশনে মিথিলা ফারজানার সঞ্চালনায় '৭১ জার্নাল' টক শোতে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে 'চরিত্রহীন' বলে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। এর জের ধরে তাকে জেলে যেতে হয়েছে। সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে কটূক্তির ঘটনায় রংপুরে করা একটি মানহানির মামলায় গত ২২ অক্টোবর রাতে ঢাকার উত্তরা থেকে মইনুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে সক্রিয় মইনুলকে গ্রেপ্তার করা হয় ফ্রন্টনেতা আ স ম রবের বাড়ি থেকে।

গ্রেপ্তারের পর তাকে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কারাগারে একটি সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। ‘আমদানি ওয়ার্ড’ নামে পরিচিত ওই ওয়ার্ডে মইনুলের সঙ্গে বন্দি আছেন আরও ৪০ জন; সেখানে কোনো খাট কিংবা চেয়ারের ব্যবস্থা নেই।

অর্থ-বিত্ত-প্রভাব-প্রতিপত্তি সব কিছু থাকার পরও ব্যারিস্টার মইনুলের এই পরিণতি দেখে মনের মধ্যে কিছু দার্শনিক প্রশ্ন উঁকি মারছে: জীবনের মানে কী? বেঁচে থাকার লক্ষ্য কী? জানি, এসব প্রশ্নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই। আমরা আসলে কেউই জানি না আমরা কেন এই ধরাধামে এসেছি। কেন বাঁচছি? কিসের আশায়, কিসের নেশায়? মানুষ বাঁচে কত দিন? বড় জোর ষাট, সত্তর কিংবা আশি বছর? একশ বছর? এটা তো গেল বেশি দিন বাঁচার হিসাব।

এর বাইরে মানুষের জীবন খুবই অনিশ্চিত। ভ্রূণ অবস্থায় মায়ের পেটে, জন্মানোর সময় অথবা জন্মের পর যে কোনো সময় ঠুস করে দম ফুরাতে পারে। তারপরও আমাদের হুঁশ হয় না। আমরা ক্ষমতা দেখাই। দাপট দেখাই। আরেকজনের ভিটেয় কীভাবে ঘুঘু চরানো যায়—সেই ধান্ধা করি। আমরা সীমার মধ্যে না থেকে সব সময় সীমা লঙ্ঘনের সাধনায় মশগুল হই। আমাদের দেশে কেউই সীমার মধ্যে থাকেন না। পুলিশ-সান্ত্রী-সেপাই কেউ না। আইনজীববীরা না। বিচারকরা না। রাজনীতিবিদরা না। ধর্মবিদরা না। যাদের আমরা বলি ‘সাধারণ মানুষ’ তারাও না!

প্রত্যেক ধর্মেই আছে, সীমালঙ্ঘন কর না। সীমা লঙ্ঘনকারীকে স্রষ্টা পছন্দ করেন না। আসলে সীমা লঙ্ঘনকারীকে কেউ-ই পছন্দ করেন না। তারপরও সবাই সীমালঙ্ঘনকেই যেন জীবনের অলিখিত উদ্দেশ্য বানিয়ে পথ চলে!

দু’দিনের দুনিয়ায় আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি। অথচ আমরা কতকিছু নিয়ে মাথা ঘামাই। কত তুচ্ছ কারণে অপরের মাথা ফাটাই। আসলে এই পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জীবনবোধের সমস্যা। কীভাবে জীবনটা যাপন করব-সেই লক্ষ্য নির্ধারণে সমস্যা। কার এক লেখায় যেন পড়েছিলাম, আমাদের প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আপনি যদি মনে করেন জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত, তাহলে দেখবেন, জীবনটাকে আপনি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা প্রায় সবাই মনে করি, আমাদের হাতে প্রচুর সময় রয়েছে, জীবনের আয়ু সংক্ষিপ্ত নয়।

আমাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করা উচিত, এ পৃথিবীতে আমাদের সময় খুব সামান্য। আজ থেকে ৫০ অথবা ৭৫ বছর পর কেউ হয়তো আমাকে আর চিনবে না। কাজেই এখন যা নিয়ে ভাবছি, মাথা ঘামাচ্ছি, এসব নিয়ে চিন্তা করে ঘুম নষ্ট করার দরকার কী! আমাদের প্রয়োজন টাকা, আমাদের প্রয়োজন সম্পদ, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এসব অর্জনেরও একটা সীমা আছে!

প্রত্যেকের বোঝা উচিত, ‘প্রয়োজন’ ও ‘লোভের’ মধ্যে পার্থক্য কী। জানা উচিত, ঠিক কোন জায়গাতে থামতে হবে এবং এটাও জানা উচিত, ‘আর নয়, অনেক হয়েছে’ কথাটা কখন বলতে হবে। অনিশ্চয়তা আপনাকে খতম করে দিচ্ছে? পৃথিবীর সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির দিকে তাকান, তিনিও বলবেন, ভয় লাগে, কখন সব শেষ হয়ে যায়! আপনি যদি এই অনিশ্চয়তার ভয় কাটাতে পারেন, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। অনেকেই আপনাকে খারাপ মানুষ মনে করতে পারে। কিন্তু আপনি নিজেকে কখনোই খারাপ মনে করেন না। এটা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজের সংকীর্ণতা ও খারাপটাকে বুঝতে শিখতে হবে!

যখন একটি পশু মারা যায়, সে একেবারেই মরে যায়। পশুদের এমন কোনো প্রজন্ম নেই যারা তাদের জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সরবরাহ করতে পারে। কোনো পশুই বই লিখতে পারে না, যে বই বছরের পর বছর অন্য প্রাণীরা পড়তে পারে, কিন্তু মানুষ পারে। তাই মানুষের জ্ঞান আসলে ‘অ্যাকুমুলেটেড নলেজ’ মানে ‘সঞ্চিত জ্ঞান’। মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে হবে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়, বাড়াবাড়ি না করে, অপরের দুঃখের কারণ না হয়ে!

আমাদের চরিত্রে রয়েছে অদ্ভুত বৈপরীত্য। গালাগাল, বিষোদগার-খিস্তি-খেউড়কে আমরা ‘বস্তি-কালচার’ বলে হেয় করে দেখলেও বস্তিবাসীর ঝগড়া কিন্তু ঠিকই উপভোগ করি। যদিও কেউ তা স্বীকার করি না। সেটা আমাদের মজ্জাগত ভণ্ডামি। আমরা একে-অপরের দোষ ধরি, নিজের পক্ষে না গেলে গালাগাল করি। উচ্চকিত হই। তখন গালি আর বুলি এক হয়ে যায়। আর আমরা একটা ইস্যু পেলে সমবেতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চালিয়ে যাই। এ ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি করি। সীমা লঙ্ঘন করি। আর যা অনবরত বের হতে থাকে তা খারাপ লাগবেই।

মূল কথা হচ্ছে থামতে জানা। পরিমিতি বোধ। ওটা না থাকলে অতি রসিকও বেরসিক বনে যাবেন এবং বিরক্তিকর চরিত্রে পরিণত হবেন!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর