বিস্মৃতির অতল থেকে জেগে ওঠা তিন আগুনপাখি

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 06:10:53

বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া তিন তরুণকে সিলেট শহর স্মরণ করছে, যারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিল মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ইতিহাসের পাঠ এমনই যে, আদর্শভিত্তিক যেকোনো আত্মত্যাগকেই সে স্মরণ করে কোনো না কোনো সময়ে। মুনির, তপন ও জুয়েলের সে পাঠ ছিল তেমনই। তাই প্রজন্মের বদল হয়েছে কিন্তু চেতনার বিনাশ হয়নি। বিস্মৃতির অতল থেকে জেগে ওঠা তিন আগুনপাখি জানান দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব।

১৯৮৮ থেকে ২০১০ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেকেই নাম মুখে আনেনি তাদের। অনেকের ছিল প্রাণ হারাবার ভয়, আবার অনেকের ছিল ব্যবসা বাণিজ্যে অংশীদারত্ব হারানোর ভয়। এই ভয় আর স্বার্থ মিলেমিশে একাকার ছিল যাদের তাদের অনেকেই খুনিদের সাথে হাত মিলিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য দিতে যায়নি অনেকেই; কারণ সেখানেও ছিল প্রাণের ভয়, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ছিল পারিবারিক সম্পর্কের প্রভাব। আদালত খুনিদের শাস্তি দিতে পারেননি শুধু প্রমাণের অভাবে। কিন্তু সিলেটের তরুণ প্রজন্মের বিবেক ঠিকই তার সহজাত চেতনায় গর্জে ওঠতে শুরু করেছে। তরুণ প্রগতিশীলদের মুখ ও অন্তর দিয়ে ক্রমে এই প্রতিবাদের স্বর চেতনা জাগানিয়া হয়ে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে, যাচ্ছে।

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরের ২৪তম দিন। বাংলাদেশের উত্তর–পূর্ব সীমান্তের সিলেট শহরে তিন তরুণের রক্তে লাল হয়েছিল রাজপথ। প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটে চলা তিনজনের কারও ঘাড়ে পড়েছিল ধারালো অস্ত্রের কোপ, কারও ওপর করা হয় নির্বিচার পাথরের আঘাত, আবার কেউবা অস্ত্রের কোপ থেকে বাঁচাতে সুউচ্চ দালানের ছাদে ওঠে আরেক ছাদে লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারায়। সেই তিন তরুণ, নাম মুনির-তপন-জুয়েল। পুরো নাম মুনির-ই-কিবরিয়া, তপন জ্যোতি দেব, আর এনামুল হক জুয়েল। সিলেটের প্রথম ছাত্রহত্যার শিকার মুনির-তপন-জুয়েল অসাম্প্রদায়িক চেতনার অবিনশ্বর নাম।

মুনির-তপন-জুয়েল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মী ছিল। নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা ছিলেন উল্লেখের মত কণ্ঠস্বর। তাই তাদেরকে প্রাণ দিতে হয়। এবং ওটাই ছিল সিলেটের প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। জামায়াত-শিবিরের হাতে সেদিন আক্রান্ত হয় জাসদ ছাত্রলীগ, সূচিত হয় সিলেটের হত্যার রাজনীতির; এবং সে ধারা এখনও বহমান, কখনও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা আবার কখনও নিজ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে।

হ্যাঁ, খুনিরা পার পেয়ে গেছে; প্রমাণের অভাবে আদালত শাস্তি দিতে পারেনি তাদের। যে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী ছিল তারা সেই জাসদও এনিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছুদিন প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর তারাও ভুলে গেছে তাদের, স্মরণের প্রয়োজন মনে করেনি। অতঃপর দুই দশকের বেশি সময় পর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা সিলেটের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে উচ্চারিত তারুণ্য ফের প্রচারের আলোয় এনেছে বিস্মৃতপ্রায় সেই তরুণদের। গত এগারো বছর ধরে স্মরণ করা হচ্ছে মুনির-তপন আর জুয়েলকে, আলোর মিছিলের মাধ্যমে, এবং সেটা হচ্ছে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মোর্চার ব্যানারে।

কী ঘটেছিল সে দিন? পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮; সকালেই সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাস দখল হয়ে যায়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস দখল করে শহরের চৌহাট্টাস্থ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এমসি কলেজ পর্যন্ত সশস্ত্র মহড়া দিতে থাকে মোটরসাইকেল ও টেম্পো সহযোগে। শিবিরের সে দখলের কারণে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর কেউই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারছিল না। তখন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টেম্পোযোগে একদল সশস্ত্র কর্মী শাহী ঈদগাহ এলাকায় জড়ো হওয়া জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়।

সে সময় তারা মুনিরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে চলে যায়। তপনকে ধরে মধ্যযুগীয় কায়দায় পাথর দিয়ে তার শরীর থেঁতলে দেয়। মুনির-তপন এ দুইজনকে আহত করে শিবির ক্যাডাররা ফেলে চলে গেলে এলাকাবাসী তাদেরকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। একই দিন এক মিছিল থেকে স্কুলছাত্র জুয়েলকে ধাওয়া করে শিবির ক্যাডাররা। শিবিরের ধাওয়া খেয়ে জুয়েল দৌড়ে একটা মার্কেটের ছাদে ওঠে পড়ে। ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র কর্মীরা ছাদে ওঠেও ধাওয়া করে জুয়েলকে। একপর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যেতে লাফ দেয় সে, পারেনি; ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। জুয়েল স্কুলছাত্র হলেও শিবিরের স্কুল রাজনৈতিক প্রচারণার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে তাকে আক্রমণ করা হয়। একইদিন এ তিন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সিলেট শহরে ছাত্রহত্যার রাজনীতি শুরু হয়।

শহীদ মুনির-তপন-জুয়েল রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সত্য কিন্তু তাদের চেতনা ছিল অবিনশ্বর একটি চেতনা যা অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করত। স্বভাবত সেখানেই তাদের বিরোধ ছিল মৌলবাদী, ধর্মান্ধ জামায়াত-শিবিরগোষ্ঠীর সাথে। তখন ছিল স্বৈরাচারের কাল এবং স্বৈরাচারের সাথে সব সময়েই মৌলবাদী ও ধর্মান্ধদের আঁতাত থাকে। এরশাদশাহীর সাথে মৌলবাদী জামায়াতের সে সময়কার আঁতাতের ফলে বিনাবাধায় প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দেয়।

সিলেটের প্রথম ছাত্র হত্যাকাণ্ডের শিকার মুনির-তপন-জুয়েল অসাম্প্রদায়িক চেতনার অবিনশ্বর নাম। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তাদের সেই আত্মত্যাগের স্মরণ করছে এই প্রজন্মের তরুণেরা। আলোক প্রজ্বলনের মাধ্যমে মৌলবাদের অন্ধকার দূর করতে প্রতিবছরই আলো হাতে শহর প্রদক্ষিণ করে একদল তরুণ। খুনের ওই রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার ওই বিষবাষ্প কেবল সিলেটেরই নয়, পুরো দেশের। মুনির-তপন-জুয়েল কেবল সিলেটের থাকেননি, হয়ে আছেন দেশচিত্র হয়ে। তারা অবশ্যপাঠ্য, আলোক প্রজ্বলনে অন্ধকার দূরীকরণের যে বার্তা সেটাও তাই আঞ্চলিক নয়, জাতীয়।

দীর্ঘ বিরতি শেষে ফের স্মরণে-শ্রদ্ধায় ফেরা মুনির-তপন-জুয়েলের আত্মত্যাগকে তাই বৃথা বলা যায় না। তারা সফল হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগকে আরও বিস্তৃতভাবে স্মরণ করতে ২৪ সেপ্টেম্বর সারাদেশে পালিত হোক ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস’।

কবির য়াহমদ: লেখক, সাংবাদিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর