কী আছে ফোর্ট ডেট্রিকে?

, যুক্তিতর্ক

সৈয়দ সাইফুদ্দিন আলী | 2023-08-30 06:10:58

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অবস্থিত ফোর্ট ডেট্রিকের সন্দেহজনক স্থাপনা নিয়ে বহু বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সেনা গবেষণা ও উন্নয়ন কমান্ড বহু বছর ধরে মানুষের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সন্দেহজনকভাবে এ প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িত থাকতে দেখা গেছে। ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে শুরু করে অ্যানথ্রাক্স ও সর্বশেষ কোভিড-১৯ এর উৎস-সন্ধান – প্রতিটি বিষয়েই ভূ-রাজনৈতিক হুমকির বাইরে দূর্নীতি ও অনিয়মের মূল শিকড় উদঘাটন করতে গিয়ে বিভিন্ন দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক মিডিয়া বারবার ফোর্ট ডেট্রিকের দিকে আঙুল তুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের রাসায়নিক বিষক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটিকে ঘিরে সন্দেহের মাত্রা আরও তীব্র হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর দ্বারা অবৈধ বিষাক্ত রাসায়নিক (টক্সিন) পরিবহনের বেশ কয়েকটি ঘটনাকে উল্লেখ করে কোরিয়ান ফায়ার সেফটি এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশন একটি মামলা দায়ের করেছিলো। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষার নামে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন স্থানে মার্কিন সেনাবাহিনীর জৈব পরীক্ষাগার দ্বারা বোটুলিনাম, রিসিন ইত্যাদির মতো টক্সিন পরিবহন করা হয়েছে। কিন্তু, এ জাতীয় পদার্থগুলো মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন পদার্থের উৎপাদন, পরিবহন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিরুদ্ধে আইন রয়েছে।

এ ধরনের আইন বহির্ভুত কার্যক্রমের বিষয়ে জানার পর দক্ষিণ কোরিয়ার সুশীল সমাজ দেশের আইনের ওপর শ্রদ্ধাশীল হয়ে ফোর্ট ডেট্রিক জৈবিক পরীক্ষাগার ও ইউএস ফোর্সেস কোরিয়া’র (ইউএসএফকে) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মামলায় মেরিল্যান্ডের ফোর্ট ডেট্রিকের ইউএস আর্মি মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইনফেকশাস ডিজিজেস ও ইউএসএফকে’র কমান্ডার পল ল্যাকামারার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল।

ইবোলা ভাইরাসের মতো বিপজ্জনক জীবাণুর সাথে জড়িত সংবেদনশীল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফোর্ট ডেট্রিকের অভ্যন্তরে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। অফিশিয়াল মুখপাত্রদের উদ্ধৃতি নিয়ে ২০১৯ সালের আগস্টে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বোচ্চ সুরক্ষিত ল্যাবগুলো থেকে আসা “দূষিত বর্জ্যপানির জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা না থাকায়” যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) আগের মাসে ফোর্ট ডেট্রিকে গবেষণা নিষিদ্ধের জন্য “বিরতি ও বন্ধ আদেশ” জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সিডিসি’র গবেষণা স্থগিত করার নির্দেশের পর এজেন্ট প্রোগ্রাম হিসেবে ফোর্ট ডেট্রিকের ইনস্টিটিউটের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছিল।  

যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে এবং এর মাধ্যমে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে নিজেদের সৈন্য মোতায়েন করতে পারে। এছাড়াও, এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধকালীন সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যদের কমান্ড দিতে পারে এবং মার্কিন সামরিক আদালতের অধীনে বিচার পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। এসব বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে তৈরি হওয়া ফাঁক-ফোকরগুলো ব্যবহার করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে জৈব রাসায়নিক পরীক্ষার মতো বিতর্কিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে, এটিই প্রথম নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও বহু কর্মকাণ্ড নানা সময়ে নিরীহ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যকে বিপন্ন করেছে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর থেকে প্রকাশিত একটি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউটাতে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ল্যাব লাইভ অ্যানথ্রাক্স স্পোরকে নিষ্ক্রিয় করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং বিষাক্ত নমুনাগুলোকে তারা যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য ছয়টি দেশের ৮৬টি গবেষণাগারে গবেষকদের কাছে পাঠিয়েছিল। ইয়োনহ্যাপ নিউজ এজেন্সি নিশ্চিত করেছে যে, এর পূর্বে ২০১৫ সালের মে মাসে ইউএসএফকে বলেছিল যে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ওসান এয়ার বেজে অ্যানথ্রাক্স’র নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। কিন্তু, পরবর্তীতে একই বছর ইয়োনহ্যাপ দারি করে যে ইউএসএফকে’র বিবৃতিটি ছিল বানোয়াট, প্রকৃতপক্ষে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সিউলের ইয়ংসান গ্যারিসনেই মৃত অ্যানথ্রাক্স নমুনা ব্যবহার করে ১৫টি পরীক্ষা চালানো হয়েছিল।  

এমন অবিবেচনাপ্রসূত অনিয়ম সচেতন ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রসমূহের দৃষ্টির অগোচরে থাকেনা। সম্প্রতি, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও চীনের সচেতন নাগরিক ও নেটিজেনদের অংশগ্রহণে একটি অনলাইন পিটিশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। এ দেশগুলো ফোর্ট ডেট্রিকের অভ্যন্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে মার্কিন স্বচ্ছতার অভাব সম্পর্কে তাদের হতাশা প্রকাশ করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে সঠিক তদন্তের জন্য তাদের “দরজা খুলে দেয়ার” আহ্বান জানিয়েছে। সম্প্রতি, আড়াই কোটি চীনা নাগরিকও কোভিড -১৯ এর উৎস সন্ধানে ফোর্ট ডেট্রিক ল্যাবের তদন্তের জন্য একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ফোর্ট ডেট্রিকের রহস্য উন্মোচনের দাবি উঠে আসছে, অথচ এর বিপরীতে তাদের পক্ষ থেকে উল্টো বিভিন্ন ভ্রান্ত অভিযোগ আসতে দেখা গেছে।  

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার হলেও উৎস সন্ধানের ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে গেলেই মনে হয় সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর এ রহস্যাবৃত জায়গার মধ্যেই রয়ে গেছে।  

লেখক: বাংলাদেশ ভিত্তিক সমসাময়িক বিষয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন ফ্রিল্যান্স পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষক. ই-মেইল: syed.saif_ali0826@gmail.com

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর